খুলনায় বিপদজনক মাত্রায় বায়ুদূষণ: অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে নির্দেশ

খুলনা বিভাগের কয়েক জেলার বায়ু বিপদজনক মাত্রায় দূষিত হয়ে পড়ায় অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

শুভ্র শচীনখুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2019, 08:30 AM
Updated : 30 Nov 2019, 01:27 PM

শহরে বায়ুর মানের সূচক ২০০ ছাড়ালেই যেখানে অস্বাস্থ্যকর ধরা হয় সেখানে এ বিভাগের কোথাও কোথাও সাতশ’ পর্যন্ত সূচক উঠে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক সাইফুর রহমান খান।

তিনি জানান, বিভাগের সব জেলা প্রশাসককে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদসহ ড্রাম চিমনির ইটভাটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নির্মাণকাজে জড়িতদের পর্যাপ্ত পানি ছিটিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দক্ষিণের ১০ জেলার মধ্যে বাগেরহাটে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করে সাইফুর রহমান খান বলেন,“এরপরই খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরার অবস্থান।”

বাগেরহাটের বায়ুদূষণ মাত্রা বেশি হওয়া প্রসঙ্গে সাইফুর রহমান খান বলেন, ওই এলাকায় সিমেন্ট কারখানা থাকায় বায়ুর সূচক গত ছয় মাসে ৭শ’ পর্যন্ত উঠেছিল।

কোনো শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে থাকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিইউএইচও) ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএ।

তিনটি স্থায়ী স্টেশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিভাগের বায়ুদূষণ  পরিমাপ করা হয় বলে জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের অনুসন্ধানে দেশে বায়ুদূষণের প্রধান উৎস হিসেবে ইটভাটা, যানবাহনের কালোধোঁয়া ও নির্মাণকাজ বেরিয়ে আসে। গত আট বছর ধরে এ তিন উৎস বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

তাছাড়া বাগেরহাট থেকে মোংলা পোট পর্যন্ত সড়কের অবস্থা খারাপ হওয়ায় যানবাহন চলাচলের সময় ধুলাবালির কারণেও বায়ুদূষণ হচ্ছে বলে জানান এ পরিবেশ কর্মকর্তা।

দূষণে এরপরই খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা ও ডাকবাংলার মোড় এলাকার অবস্থান উল্লেখ করে তিনি বলেন, যানবাহন থেকে কালোধোঁয়া এবং অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণাধীন কাজ এ দূষণের সৃষ্টি করছে।

“যশোর জেলার নওয়াপাড়া-বসুন্দিয়া-মনিহার এবং খুলনা-সাতক্ষীরা সড়ক সংস্কারের কারণে যশোর ও সাতক্ষীরায় ব্যাপকহারে বায়ুদূষণ হচ্ছে।”

তবে নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় বায়ুদূষণ কম বলে জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ারের পর্যবেক্ষণে চলতি মাসে অন্তত আট দিন ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে উঠে আসে।

এ দূষণ রোধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বায়ুদূষণ রোধে সরকারের সব মহলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

“জনগণকেও দূষণ রোধে সচেতন হতে হবে।”

মূলত দূষণের উৎসগুলো কমাকে নজর দিতে হবে বলে জানান তিনি।

যানবাহনের ধোঁয়া রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে খুলনা বিআরটিএ-র সহকারী পরিচালক মো. আবুল বাসার বলেন, “সাড়ে চার হাজারের মত যানবাহনের ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন ও রুট পারমিটের কাগজপত্র হালনাগাদ নেই। এর মধ্যে বেশি হচ্ছে বাস, ট্রাক, বেবীট্যাক্সি ও পিকআপ।

“এসব যানবাহনগুলোতে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাসহ স্ব স্ব মালিকদের কাগজপত্র নবায়নের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।”

তবে বায়ুদূষণের জন্য নাগরিকরাও অনেকটা দায়ী ভাবছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. দিলীপ কুমার দত্ত।

তিনি বলেন, “আমরা নিজেরাই অনেকটা দায়ী। পাশাপাশি শিল্প কলকারখানা ও যানবাহন মালিকদেরও অসচেতনতা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।

“বাতাসে বালুর পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বায়ুদূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। আমরা প্রত্যেকে যদি সচেতন হই তবে বায়ুদূষণ অনেকাংশ কমবে।”

তবে যানবাহনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে এবং নির্মাণকাজের ধুলা নিয়ন্ত্রণে তেমন উদ্যোগ নেই দাবি করে খুলনার গবেষণা সংস্থা লাইভের নির্বাহী পরিচালত নাজমুল হক লাকী শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলা এবং জলাশয় রক্ষা করার কথা বলেন ।

“সবার আগে বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে দেখতে হবে। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এটি সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

“আইন অনেক হয়েছে, এগুলো প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ২০৭০ সালের মধ্যে দেশের কৃষিজমি নাই হয়ে যাবে। তাই ইটভাটা ও আবাসন শিল্পে জমির ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।”

দূষণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রসঙ্গে খুলানার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে গেলে শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, স্নায়ুজনিত সমস্যাও বেড়ে যায়।

“বায়ুদূষণে শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘিত্ন হওয়ার পাশাপাশি ফুসফুসে সংক্রমণ, সর্দিকাশি ও চোখের সংক্রমণ বাড়ছে।”

বায়ুদূষণের কারণে এশিয়ায় প্রতিবছর ২৬ লাখ এবং  বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে গত ২২ জুন ঢাকায় এক সেমিনারে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান তথ্য দিয়েছেন।

‘বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শহুরে মানুষ। শিশু, দরিদ্র এবং বয়স্ক নাগরিকরা এর বেশি শিকার হয় বলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ ১০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের আয়োজনে ওই সেমিনারে তিনি জানিয়েছেন।

এছাড়া ২০১৬ সালে বিশ্বে প্রতি সাতজন নতুন ডায়াবেটিস রোগীর একজনের আক্রান্ত হওয়ার পেছনে ঘরের বাইরের বায়ু দূষণকে মনে করছেন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা বলে বিবিসি এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে।