সুন্দরবনে রাসমেলা শুরু রোববার

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনে হতে যাচ্ছে ‘রাসমেলা।‘

শুভ্র শচীন খুলনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Nov 2019, 08:10 AM
Updated : 8 Nov 2019, 08:11 AM

কার্তিক-অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে প্রতিবছর সুন্দরবনের ‘দুবলার চরে’ বসা এ মেলায় হাজার হাজার পুণ্যার্থী আর পর্যটক ভিড় করে।

১০ নভেম্বর শুরু হতে যাওয়া তিনদিনের এ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।

রাসমেলা মণিপুরীদের প্রধান উৎসব হলেও বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন স্থানে এ উৎসব পালন করে থাকে।

‘রাসলীলা’ নামেও পরিচিত এ উৎসব কার্তিক-অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, সুন্দবনের দুবলার চর এবং কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতেও পালিত হয়।

এ বছর দুবলার চরের এ মেলায় দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীদের নিরাপদে যাতায়াতের জন্য সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগ আটটি পথ নির্ধারণ করেছে। এ সব পথে বনবিভাগ, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর টহলদল সবার জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ।

সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বশিরুল আল মামুন বলেন, রাসমেলাকে কেন্দ্র করে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক টহল নিয়োজিত থাকবে।

তীর্থযাত্রীরা যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে তার জন্য সব রকম  সহযোগিতা দেওয়া হবে বলেও জানান এ বন কর্মকর্তা।

যেভাবে যেতে হবে

অনুমোদিত আটটি পথে দুবলার চরের এ মেলায় যাওয়ার প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলানদী-বলনদী-পাটকোস্টা হয়ে হংসরাজ নদী হয়ে দুবলারচর।

কদমতলা হতে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর।

কৈখালী স্টেশন হয়ে মাদার গাং, খোপড়াখালী ভাড়ানী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর।

কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাসিটানা, বজবজা হয়ে আড়ুয়া শিবসা-শিবসা নদী-মরজাত হয়ে দুবলার চর।

নলিয়ান স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলার চর।

ঢাংমারী অথবা চাঁদপাই স্টেশন হয়ে পশুর নদী দিয়ে দুবলারচর।

বগী-বলেশ্বর-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর।

শরণখোলা স্টেশন-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর।

দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীদের ‘১০ নভেম্বর থেকে তিনদিনের জন্য অনুমতি প্রদান করা হবে’ এবং প্রবেশের সময় নির্দিষ্ট ফি প্রদান করতে হবে বলে জানান বন কর্মকর্তারা।

বন কর্মকর্তা জানান, যাত্রীরা নির্ধারিত রুটগুলো মধ্যে পছন্দ মতো যেকোন একটি মাত্র পথে দিনের বেলায় চলাচল করতে পারবেন।

“বনবিভাগের চেকিং পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানো যাবে না।

“প্রতিটি ট্রলারের গায়ে রং দিয়ে বিএলসি অথবা সিরিয়াল নম্বর লিখতে হবে।”

নির্দেশনা

মেলায় যোগ দিতে হলে আরও কিছু নিয়ম মানার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা, রাস পূর্ণিমায় আগত পুণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় ‘জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সনদপত্র’ নিয়ে আসতে হবে।

পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, ‘মাইক বাজানো, পটকা ও বাজি ফোটানো, বিস্ফোরকদ্রব্য, দেশীয় যে কোনো অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র বহন’ করতে পারবে না।

তাছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অবস্থানকালীন সবসময় টোকেন ও টিকেট সঙ্গে রাখতে হবে।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা এবং বন ও বন্যপ্রাণি রক্ষায় বন বিভাগের সঙ্গে নৌবাহিনী, র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও পুলিশ নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া, কন্ট্রোল রুমে সার্বক্ষণিক একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তদারকির দায়িত্বে থাকবেন।

তিনি বলেন, ‘এবার রাস উৎসবের নিয়মাবলীতে একটু ভিন্নতা আনা হয়েছে। আগের বছরগুলোতে পুণ্যার্থীরা রাতে রওনা হতো কিন্তু এবার নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে ১০ নভেম্বর ভোর ৬টা থেকেই যাত্রা শুরু করতে হবে।”

তাছাড়া নারী পুণ্যার্থীদের পোশাক পরিবর্তনের জন্য আলাদা শেড ও পর্যাপ্ত টয়লেট তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান হাসান।

রাস মেলা নিয়ে ইতিহাস ও বিশ্বাস

প্রধানত মৎস আহোরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের দ্বীপ আলোরকোল, ককিলমনি, হলদিখালি, কবরখালি, মাঝেরকিল্লা, অফিসকিল্লা, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, মেহেরআলির চর এবং শেলারচর নিয়ে দুবলারচরের মোট আয়তন ৮১ বর্গমাইল।

তবে ঠিক কবে থেকে জেলেরা এখানে মৎস্য আহরণ করতে আসে, কবে থেকে এখানে রাসমেলা শুরু হয় অথবা দুবলার চরের নামকরণ নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত।

স্থানীয়রা জানায়, ‘রস’ থেকে ‘রাস’ কথাটির উৎপত্তি- আর রস ‘আস্বাদনের’ জন্য পালিত হয় বলে এর নাম হয়েছে রাসমেলা। আবার কেউ কেউ মনে করেন- বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের আধ্যাত্মিক রাসলীলার অনুকরণে রাসমেলার উদ্ভব হয়েছে।

মণিপুরী সমাজে রাস উৎসবের প্রবর্তক মনিপুরের রাজা মহারাজ জয়সিংহ (রাজত্ব ১৭৬৪-১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ)। বাংলাদেশে মণিপুরীরা স্থায়ী বসতি স্থাপনের পর ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়ামণ্ডপে নিয়মিতভাবে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে, বর্তমানে আদমপুরের তেহাইগাঁও ও হবিগঞ্জের জয়শ্রী গ্রামেও এ উৎসব পালিত হয়।

ওই অঞ্চলের রাসমেলার প্রধান দিক হলো-চিরাচরিত মনিপুরী পোশাকে শিশুদের রাখাল নাচ ও তরুণীদের রাসনৃত্য। এছাড়া মণিপুরী সংগীত ও নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে কৃষ্ণ-অভিসার, রাধা-গোপী অভিসার, রাগ আলাপন ইত্যাদি অভিনীত হয়ে থাকে।

কেউ কেউ একে ‘মগদের মেলা’ বলেও থাকেন। মেলার শেষ দিন প্রত্যূষে প্রথম জোয়ারে পুণ্যস্নান সমাপনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় এ উৎসব।

দুবলারচরের রাসমেলা সম্পর্কে খুলনা অঞ্চলের লেখক-গবেষক সঞ্জিব হাউলী বলেন, “এটি মূলত ‘নিম্নবর্ণের’ হিন্দুদের একটি পুণ্যোৎসব। হিন্দু পৌরাণিক মতে, রাস হচ্ছে রাধা-কৃষ্ণের মিলন।”

স্থানীয় অনেকের মতে- ২০০ বছর আগে হিন্দু সম্পদায়ের এক ‘ক্রান্তিলগ্নে’ বৃহত্তর ফরিদপুরের (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামে) জন্ম হয় মতুয়া সাধক ব্রাক্ষণপুত্র হরিঠাকুরের।

তিনি বৃদ্ধ বয়সে ‘স্বপ্নাদ্রষ্ট হয়ে দুবলারচরে পূজা-পার্বণ শুরু করেন’ এবং তার অনুসারীদের তার পথ অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। সেই থেকে প্রতিবছর বাংলা কার্তিক মাসের রাসপূর্ণিমা তিথিতে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে সনাতন সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষ দুবলারচরে আসে।

‘পাপমোচন ও পার্থিব জীবনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্য‘ পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে এ উৎসব পালন করে আসছেন তারা।

তবে কারও কারও মতে, বার ভূইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্য এ পূজা ও মেলার প্রবর্তন করেন।

মৎস্য আহরণের মৌসুমে এটি হয় বলে অনেকে দুবলার চরের এই মেলাকে মৎস্য আহরণ শুরু উৎসবও মনে করা হয়।

প্রাচীনযুগে নানা কারণে সমুদ্রযাত্রা ও মৎস্য আহরণ করার সময় মানুষ তীরে পূজা-অর্চনা করে সমুদ্রে নামতেন। দুবলারচর মূলত সমুদ্রের একটা বড় প্রবেশদ্বারে নদীসংলগ্ন মোহনা। এ কারণেই হয়ত এই নদী মোহনাসংলগ্ন দ্বীপে পূজা প্রচলিত হতে পারে-যা ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে রাসমেলায় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।

দুবলারচরের রাস মেলায় যা হয়

এ মেলায় সনাতন ধর্মালম্বীরা তাদের দেবতা নীল কমল ও গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে পূজা দেন।

দুবলারচরের যে স্থানে মেলাটি হয়, তার নাম আলোরকোল। সেখানে মেলার তিনদিন আগে থেকে অনেক অস্থায়ী দোকানপাট বসে। দোকানে বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি, খেলনা, ফলমূল, মাটি ও ঝিনুকের তৈরি অলঙ্কারা পাওয়া যায়। মেলা উপলক্ষে একটি অস্থায়ী মন্দিরও তৈরি করে চলে পূজার্চনা।

প্রতিদিন বিকাল থেকে শুরু হয় বাউল, কবিগান, কীর্ত্তন, জারি, গাজিরগানসহ বিভিন্ন রকম লোকজ অনুষ্ঠান। রাস পূর্ণিমায় সারা রাত অনুষ্ঠান দেখার পরে খুব ভোরে প্রথম জোয়ারে সবাই পূর্ণস্নান করতে সমুদ্রের পাড়ে আসেন। এ সময় মন্ত্র উচ্চারণ করে ডাব, মিষ্টি, ফলমূল, জীবজন্তু উৎসর্গ করা হয়।

অনেকে সন্তানাদি লাভের জন্যও মানত করেন এবং ডাব, আগরবাতি ও বাতসা সামনে রেখে আঁচল পেতে বসেই থাকেন। তাদের ধারণা, ঢেউয়ের সঙ্গে ডাবটি আঁচলে ধরা দিলে তারা সন্তান লাভ করবেন।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পূর্ণিমায় সাগরের জোয়ারের নোনাজলে স্নানের মধ্যদিয়ে পাপমোচন এবং মনস্কামনা পূর্ণ হবে- এমন বিশ্বাসেরাসমেলা যোগ দিলেও সময়ের ব্যবধানে এখন তা নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে।

তাছাড়া এ মেলাকে কেন্দ্র করে সমুদ্র দর্শন, দুবলারচর থেকে সূর্যোদয়ও সূর্যাস্ত নিখুতভাবে দেখা যায়।তাই বর্তমানে এ মেলার দেশের বিভিন্নস্থান থেকে পূর্ণার্থী ছাড়াও আসেন দেশি-বিদেশি বিপুল সংক্ষক পর্যটক।

সবমিলিয়ে মেলার ক’দিন সুন্দরবনের অভ্যন্তরের নির্জন দুবলারচর বর্ণীল আলোয় আলোকিত থাকে। ছোট একটি শহরের মতো মনে হয়।

মেলার তীর্থ যাত্রীরা পানির অভাবে পড়লে দুবলার বালুচরের কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করেন, যা মেলার দর্শনার্থী ও পর্যটদের জন্য আরও এক বড় আর্কষণ ।

বিশ্বের বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের ঘন শ্যামল গাছপালা ও পশুপাখির আর্কষণে এই মেলায় দিন দিন দর্শনার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে।