আমার শেষ যাত্রার কফিনে তাদের স্যালুট নয়: মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার চিঠি

‘তুচ্ছ’ ঘটনায় সরকারি গাড়িচালক ছেলেকে চাকরি ও বাস্তুচ্যুত করাসহ মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে দিনাজপুরে এক মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসনের গার্ড অব অনার প্রত্যাখ্যান করে চিঠি লিখেছিলেন স্থানীয় সাংসদের কাছে, যার একদিন পর তিনি মারা যান।

দিনাজপুর প্রতিনিধিমোর্শেদুর রহমান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Oct 2019, 03:54 PM
Updated : 24 Oct 2019, 04:08 PM

এ কারণে পরিবারের অনীহার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েও এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দিতে পারেনি।

বুধবার রাতে এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিনাজপুর সদরের যোগিবাড়ী গ্রামের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের (মুক্তিবার্তা নম্বর- ০৩০৮০১১০০২) মৃত্যু হয়।

বৃহস্পতিবার নিজ গ্রামেই তাকে দাফন করা হয়েছে গার্ড অব অনার ছাড়াই। 

মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের ছেলে নুর ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়িচালক পদে ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ ভিত্তিতে চাকরি করছিলেন। সেই সুবাদে তিনি একটি সরকারি পরিত্যক্ত বাড়িতে বসবাসের সুযোগ পান।

নুর ইসলাম বলেন, গত সেপ্টেম্বরে সহকারী কমিশনার তার বাড়িতে একটি ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে অসন্তুষ্ট হন। এরপর তার চাকরি চলে যায় এবং বসবাসের বাড়ি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়।

বিষয়টি নিয়ে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন ছেলের চাকরি ফিরিয়ে দিতে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে বার বার অনুরোধ করেও সাড়া পাননি বলে নুর জানান।

“পরে জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম বরাবর বিষয়টি উল্লেখ করে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২২ আক্টোবর একটি চিঠি লিখেন এবং পরদিনই তার মৃত্যু হয়।”

চিঠির শেষ অংশে তিনি লেখেন মৃত্যুর পর তাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়।

চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের বক্তব্য হলো, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে ছেলে নুর ইসলামের ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ ভিত্তিতে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি হয় ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে নুর ইসলাম দিনাজপুর সদর উপজেলা এসি ল্যান্ডের [সহকারী কমিশনারের (ভূমি)] গাড়ি চালাতেন।

এক পর্যায়ে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এ্সি ল্যান্ডের স্ত্রী নুর ইসলামকে শৌচাগার পরিষ্কার ও মাংস রান্না করতে বলেন। মাংস রান্না ঠিক না হওয়াসহ বিভিন্ন অজুহাতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে চাকুরিচ্যুত করা হয় বলে চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন।

এরপর নুর ইসলামকে তার বসবাসরত সরকারি বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।  

চিঠিতে আরও লেখেন, পরে স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা জাকারিয়াকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে জেলা প্রশাসকও তার উপর রাগ করেন। এরপর নুর ইসলাম তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাফ চাওয়ার জন্য এসিল্যান্ডের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেও দেখা করতে পারেননি।

এর পরিপ্রেক্ষিতে উপায় না পেয়ে ইসমাইল ও তার ছেলে নুর সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু এরপরও  কোনো প্রতিকার হয়নি।

চিঠির সবশেষে ইসমাইল লেখেন, “তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন তুমি ন্যায়বিচার কর। ঠুনকো অজুহাতে আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত করায় তাকে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আমার বয়স প্রায় ৮০ বৎসরের কাছাকাছি। ছেলেটি হঠাৎ করে চাকরিচ্যুত হওয়ায় একেই তো আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ তারপর মানসিকভাবেও ভেঙ্গে পড়েছি। জীবণ মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন না করা হয়। কারণ এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত, বাস্তুচ্যুত করে পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম/স্যালুট আমার শেষ যাত্রার কফিনে আমি চাই না।”

এ বিষয়ে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম বলেন, “আমি তো গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটসহ গার্ড অব অনার দলকে পাঠিয়েছি। কিন্ত পরিবারের বাধায় তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া সম্ভব হয়নি।”

সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।