স্বচ্ছলতার গল্পগাথা, নকশি হাতপাখা

এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরালেও নকশি হাতপাখা বিক্রি করে স্বচ্ছলতা এসেছে গাইবান্ধার দুই গ্রামের অনেক পরিবার।

তাজুল ইসলাম রেজা গাইবান্ধা প্রতিনিধি.বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Oct 2019, 09:38 AM
Updated : 16 Oct 2019, 11:22 AM

সাদুল্লাপুর উপজেলার আরাজি ছান্দিয়াপুর ও বুজরুক রসুলপুর পাশাপাশি গ্রামের মানুষেরা তাদের ভাগ্য ফিরিয়েছে হরেক রংয়ের সুতার বুননে।

গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার পশ্চিমে সাদুল্লাপুর উপজেলা সদর। সেখান থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে রসুলপুর ইউনিয়নের আরাজি ছান্দিয়াপুর। পাশের গ্রাম বুজরুক রসুলপুর অবশ্য জামালপুর ইউনিয়নের ভেতর পড়েছে।

সরেজমিনে গ্রাম দুইটি ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই হাত পাখা তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ সুতা গোছাচ্ছেন, কেউ বাঁশ কাটছেন, কেউ আবার বাঁশের চাক তৈরি করছেন, কেউ সুঁই-সুতা দিয়ে সেলাই করে বুনছেন হাতপাখা।

গ্রামবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা সুতা ও বাঁশের চাক (বাতি) দিয়ে নানা রং ও নকশার হাতপাখা তৈরি করছেন। প্রতিটি হাতপাখা তৈরি করতে ১২ টাকার সুতা, দুই টাকার বাঁশের হাতল, দুই টাকার সুতা মোড়ানোর কাপড় ও পারিশ্রমিকসহ ব্যয় হয় প্রায় ২০ টাকা।

প্রতিটি হাতপাখা বিক্রি হয় ২৫-৩০ টাকায়। এসব হাতপাখা জেলার চাহিদা মেটানোর পর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এসে নিয়ে যান তারা। 

আরাজি ছান্দিয়াপুর গ্রামের আছির উদ্দিন জানান, আগে তিনি কৃষিখাতে দিনমুজুরি করতেন।

“এতে সংসারের খরচ ঠিকমতো জোগাড় হতো না। যখন দিনমজুরের কাজ থাকত না, তখন অনাহার-অর্ধাহারে থাকতে হত।

“এখন পাকা বিক্রি করে প্রতি মাসে আট হাজার টাকা আয় হয়। ফলে এখন আর অভাব নাই।”

এই গ্রামের আয়না বেগম জানান, আগে এক বিঘা জমি বর্গাচাষ আর অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে যা আয় হয়েছে, তাতে পেটে-ভাতে জীবন চালিয়েছেন। কিন্তু ঈদ এলে ছেলেমেয়েদের নতুন জামা-কাপড় দিতে পারেন নি, অসুখ হলে ওষুধের টাকা জোগাড় করতে পারেন নাই।

কিন্তু হাতপাখা তৈরি করে এখন সংসারের সব চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে বলে জানান আয়না।  

বুজরুক রসুলপুর গ্রামের আবুল ফজল মিয়া বলেন, তার সংসারের সবাই এখন হাতপাখা বানানোর কাজ করেন। পাইকাররা বাড়িতে এসে তাদের তৈরি হাতপাখা কিনে নিয়ে যায়। আবার স্থানীয় হাট-বাজারেও তারা এই হাতপাখা বিক্রি করেন।

“এতে তাদের খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা আয় হয়।”

তবে গরমের মৌসুম ছাড়া এ হাতপাখার চাহিদা থাকে না বলে জানালেন একই গ্রামের মোখলেছ বেপারী।

তিনি বলেন, “একজন প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি হাতাপাখা তৈরি করতে পারেন। শীতের সময় চাহিদা থাকে না। এ সময় নকশি হাতপাখা তৈরি করে অনেকে সেগুলো মজুত করে রাখে। গরম চলে আসলে বিক্রি করা হয়।”

মোকলেছ আরও বলেন, পাখা তৈরির কাজে নিয়োজিত বেশিরভাগ পরিবারই দরিদ্র। তাই তাদের মূলধন কম। এ কারণে প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে বেশিরভাগ পরিবার বেকার হয়ে বসে থাকে।

“সরকারিভাবে এই কাজে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।” 

জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান মণ্ডল জানালেন, গ্রামবাসীদের পাখা তৈরির কাজে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।

গাইবান্ধা বিসিকের (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন) সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক শাহ মো. জোনায়েদ বলেন, আরাজি ছান্দিয়াপুর ও বুজরুক রসুলপুর গ্রামের প্রায় ছয় হাজার মানুষ বাস করেন, যাদের বেশিরভাগই দরিদ্র।

“দিনমজুরের কাজ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। সংসারে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।

“কিন্তু বাঁশ আর সুতা দিয়ে নকশি হাতপাখা তৈরি করে এই দুই গ্রামের শতাধিক পরিবার এখন স্বাবলম্বী।”

এই দুই গ্রামের উৎপাদিত পাখা বাজারজাতকরণে সহায়তা দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি  উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানে তালিকাও তৈরির কাজ চলছে বলে জানালেন জোনায়েদ।