বুয়েট ছাত্র আবরারকে কুষ্টিয়ায় দাফন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পিটিয়ে হত্যা করা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের মরদেহ কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে দাফন হয়েছে।

কুষ্টিয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2019, 12:09 PM
Updated : 8 Oct 2019, 05:23 PM

মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে লাশবাহী গাড়ি কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোড এলাকায় তাদের বাড়িতে আসে। সেখানে ভোর থেকেই আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী ভিড় জমায়। এখানে প্রথম জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি কুমারখালী উপজেলার রায়ডাঙ্গায় নেওয়া হয় মরদেহ।

লাশবাহী গাড়ি গ্রামে পৌঁছালে প্রতিবেশী ও এলাকাবাসী ছাড়াও আশপাশের গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ আসে মৃত ফাহাদকে শেষবারের মত দেখার জন্য। সেখানে হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শোকবিহ্বল পরিবেশে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি কেউ। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ।

পরে রায়ডাঙ্গা গোরস্থান সংলগ্ন ঈদগাহ ময়দানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন হয়। তার আগে তার বাবা বরকত উল্লাহ ফাহাদের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। তিনি আগামী শুক্রবার বাদ জুমা কুলখানিতে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেন সবাইকে।

একই সঙ্গে তিনি হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। জানাজায় অংশ নেওয়া হাজার হাজার মানুষ সমস্বরে প্রতিবাদের কণ্ঠ মেলান ফাহাদের বাবার সঙ্গে।

দাফন শেষে কবর জিয়ারত করার পর ফাহাদের বাবার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়। তিনি অসুস্থ বোধ করেন। তবে হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হয়নি।

এদিকে ফাহাদের মা রোকেয়া বেগম দুই দিন ধরে না খেয়ে আহাজারি করতে করতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

ফাহাদের ফুফু আকলিমা খাতুন বলেন, “এই দেশে কি কোনো বিচার ব্যবস্থা আছে? এমন সুনার টুকরা ছেলেটা যেদিন বাড়ি থেকে গেল সেদিনই ঘতকরা মায়ের বুক খালি করল। বুয়েটের মত জায়গায় যদি এমন ঘটনা হয় তাহলে কিভাবে আর কোন মা-বাপ সন্তানদের পড়তি পাঠাবি। এই ঘটনা তো সব বাপ-মার মধ্যি আতংক সৃষ্টি কইরি দিল।

চাচাত বোন রেহেনা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, “ফাহাদের গুণাগুণ বইলি শেষ করা যাবি না। ও কারও সাথে কোনো দিন মুখ তুলি কথা কয়নি। ভদ্র, নম্র, নামাজ-কালাম আর বই ছিল ওর একমাত্র সঙ্গী। এই বই-ই ওর জীবনের কাল হলি।”

প্রতিবাদ সমাবেশে রূপ নেয় জানাজা স্থল

দাফন চলার সময় হঠাৎ করে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শোকার্ত মানুষেরা। প্রতিবাদের স্লোগান দেন তারা। সড়ক অবরোধ করে শুরু করেন প্রতিবাদ। স্লোগানে প্রকম্পিত হয় গোটা এলাকা। তারা ‘শেখ হাসিনার বাংলায় খুনিদের ঠাঁই নাই’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় খুনিদের ঠাঁই নাই’, ‘ফাহাদ ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘ফাহাদের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই’—এমন নানা রকম স্লোগান দেন।

ফাহাদের স্কুলের সহপাঠী আতিক বলেন, “আমরা একই সাথে কুষ্টিয়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করি। ওর অদম্য মেধাই ওকে আমাদের থেকে আলাদা করে ফেলল। এখন চিরতরে ফাহাদ পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে গেল। যাদের কারণে আজ ও আমাদের সকলকে ছেড়ে আলাদা হয়ে গেল তাদেরও একইভাবে পৃথিবী থেকে আলাদা করার দাবি জানাই।”

ফাহাদের অপর বন্ধু কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সোহরাব হোসেন বলেন, “স্কুলে আমরা দুজনই বসতাম ফার্স্ট বেঞ্চে। আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। এসএসসিতে দুজনই ভালো রেজাল্ট করলাম। টাকার অভাবে আমি বাইরে যেতে পারিনি। ফাহাদ গিয়েছে। ও ঠিকই ওর জায়গা করে নিয়েছে ওর মেধা আর ভাল গুণ দিয়ে। এখন দেখছি ওটাই হল ওর জীবনে কাল। এমন ঘটনা কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না।”

জানাযায় অংশ নেওয়া গোলাম মহসিন নামে এক বাবা বলেন, তার ছেলে নটরডেম কলেজে পড়ে।

“ফাহাদের ঘটনা আমার পরিবারকে কাঁদিয়েছে। এ ঘটনা আমাদের পরিবারকে চরম শংকাগ্রস্ত করে তুলেছে। এই বুঝি এমন কোনো সংবাদ আসে যা ফাহাদের পরিবারের মত আমাদেরও বিপন্নের মুখে ঠেলে দেয়। ফাহাদের মত একজন মেধাবী ছেলেকে এভাবে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা—এটা আমাদের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।”

তিনি বলেন, “আমি একজন অভিভাবক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিবেদন করি, উনি যেন একটু ভাবেন যে এ ধরনের ছাত্র রাজনীতিকে কতটুকু যৌক্তিক মনে করেন। যদিও শুনেছি উনি নিজেই তার ছাত্রনেতাদের বিষয়ে ক্ষুব্ধ। উনি এই কলঙ্কময় অধ্যায়ের লাগাম টেনে একটা পরিসমাপ্তি ঘটান।”