নিখোঁজের ৯ বছর পর মিলল মেয়েটির বাবা-মা

দশ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া এক মেয়ে শিরিন নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে নয় বছর পর ফিরে পেয়েছে তার বাবা-মাকে।

নোয়াখালী প্রতিনিধিআবু নাছের মঞ্জুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Sept 2019, 10:54 AM
Updated : 22 Sept 2019, 11:34 AM

হারিয়ে যাওয়া শিরিন আক্তার সেলিনা (১৯) নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার শূন্যের চরের সূর্যমুখী আসকা বাজার এলাকার মৎস্যজীবী মো. আবুল কাসেম মেয়ে।

শিরিনকে নিয়ে গ্রামে যাবার পর তার বাবা মো. আবুল কাসেমে জানান, রোববার সকাল থেকে গ্রামের স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা তার মেয়ে ও মেয়ের জামাইকে দেখতে বাড়িতে ভিড় করছে।

“চার দিন গ্রামে বেড়িয়ে মেয়ে ও তার জামাই চট্টগ্রাম ফিরে যাবে।”

এর আগে শনিবার বিকেলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক তন্ময় দাসের উপস্থিতিতে শিরিনকে তার বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন নিখোঁজের পর যাদের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে সেই পালক বাবা-মা, শিরিনের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, তার প্রকৃত মা-বাবা, চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা।

শিরিন আক্তার বলেন, “অনেক দুঃখ কষ্টের পর আমি আমার বাবা-মাসহ সবাইকে ফিরে পেলাম। আজ আমি অনেক খুশি।”

যারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে, নিজেদের সন্তানের মত লালন পালন করেছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শিরিন।

হস্তান্তর অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংস্থা ভোরের আলোর চেয়ারম্যান আরজু সাহাব উদ্দিন পেছনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, নয় বছর আগে সুবর্ণচরে তার নানার বাড়িতে বেড়াতে যায় শিরিন।

এ সময় তার বাবা আবুল কাশেম সাগরে মাছ ধরতে গেলে জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে। চার দিন পর আবুল কাশেমকে ছেড়ে দেয় জলদস্যুরা।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শিরিনকে তার বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।

কিন্তু নানার বাড়িতে শিরিনের জেঠা খবর পাঠান তার বাবাকে জলদস্যুরা মেরে ফেলেছে এবং এই খবরে তার মাও স্ট্রোক করে মারা গেছেন।

এরপর শিরিন তার নানির কাছেই থেকে যায়। কিছু দিন পর জেঠার সাথে নানির চিকিৎসার জন্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে যায় শিরিন। এ সময় নানি ও জেঠাকে হারিয়ে ফেলে শিরিন।

এ সময় কান্নাকাটির এক পর্যায়ে এক নারী শিরিনকে তার নানির কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে চট্টগ্রামের হালি শহরে নিয়ে যায়। সেখানে একটি বাসায় তাকে গৃহকর্মী হিসেবে ‘বিক্রি করে’ চলে যায় সেই নারী। ওই বাসায় শিরিনের ওপর নানানভাবে শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো।

ওই বাসায় তিন বছর অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে একদিন সেখান থেকে পালিয়ে যায় শিরিন। সারাদিন অভুক্ত শিরিন রাতে হালি শহরের স্বপ্না বেগমের বাসায় গিয়ে ওঠে।

কিশোরী শিরিনের কান্না দেখে স্বপ্না তাকে আশ্রয় দেয়। তার কাছ থেকে সব ঘটনা শুনে পরদিন তাকে থানায় নিয়ে যান স্বপ্না।

থানা কর্তৃপক্ষের অনুরোধে শিরিনকে নিজের ঘরেই আশ্রয় দেন স্বপ্না। এভাবে দুই-তিনদিন থাকার পর স্বপ্নার বড় বোন সানোয়ারা বেগম (৪৫) ও তার স্বামী দিদারুল আলম শিরিনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান।

হস্তান্তর অনুষ্ঠানে পালক মা সানোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমরা শিরিনকে আমাদের নিজেদের মেয়ের মতই বাংলা এবং আররি পড়ালেখা শেখানো থেকে শুরু করে সবকিছু করি।

“গত জুন মাসে ধুমধাম করে তার বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করি।”

নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে শিরিনকে তার বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।

তিনি জানান, আগে থেকেই তারা শিরিনের প্রকৃত বাবা-মায়ের সন্ধান করে আসছিলেন। এক পর্যায়ে তারা চট্টগ্রামের কাট্টলী বার্তার প্রধান সম্পাদক ও ভোরের আলোর প্রতিষ্ঠাতা মো. শফিকুল ইসলাম খানকে শিরিনের পরিবারকে খুঁজে দেয়ার অনুরোধ করেন।

অনুষ্ঠানে শিরিনের বাবা মো. আবুল কাসেমে জানান, মেয়েকে অনেক খোঁজাখুজির পর এক পর্যায়ে শিরিনকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তারা।

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম খান জানান, গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে সাইফুল ইসলাম মাছুম নামে হাতিয়ার সংবাদিককে শিরিনের কথা জানান। এরপর মাছুমের সহযোগিতায় হাতিয়ায় শিরিনের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন তারা।

শিরিন আক্তার সেলিনার বিয়ের অনুষ্ঠান

তিনি বলেন, “খোঁজ নিয়ে হাতিয়ার প্রবীণ সাংবাদিক একেএম মোস্তফা শিরিনের বাবা-মা বেঁচে আছেন বলে জানান। এরপর শিরিনের বাবা আবুল কাসেম ও মা ফাতেমা খাতুনকে চট্টগ্রামে ভোরের আলো অফিসে ডাকা হয়।

“বাবা মায়ের কাছে থাকা শিরিনের ছবি ও জন্ম নিবন্ধন সনদ মিলিয়ে দেখা হয়। শিরিনও তার বাবা-মাকে চিনতে পারে।”

সাংবাদিক শফিকুল জানান, তিনিও স্কুলে পড়ার সময় ১৫ বছর পরিবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন।

“নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমি আমার পরিবারকে ফিরে পাই।

“আমরা ভোরের আলো সংগঠনের মাধ্যমে আমার মত বিপদে পড়া শিশু-কিশোরদের জন্য কাজ শুরু করি। ”

হস্তান্তর অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস বলেন, “কারা কারা কী উদ্দেশ্যে মিথ্যা গল্প সাজিয়ে শিরিনের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছিল তাদেরকে চিহ্নিত করা হবে।”

যাদের প্রতারণার শিকার হয়েছে শিরিন। তাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হবে।