ফারুক হত্যা: জাদিমুরায় বিক্ষোভ-ভাংচুর, আতঙ্ক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় টেকনাফের জাদিমুরায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ ও ভাংচুর চালিয়েছে এলাকাবাসী।

মাসুম বিল্লাহ টেকনাফ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2019, 10:59 AM
Updated : 23 August 2019, 11:54 AM

শুক্রবার সকাল থেকে পাঁচ ঘণ্টার এ তাণ্ডবের সময় অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান। স্থানীয়দের অভিযোগ, ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা’ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

এদিকে নিহত যুবলীগ নেতা ফারুকের বাবা আবদুল মোনাফ অভিযোগ করছেন, রাজনৈতিক কারণে তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে; আর তাতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘রোহিঙ্গা অস্ত্রধারীদের’।

বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফের জাদিমুরায় ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুককে।

জাদিমুরা এমআর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফারুক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ঠিকাদারিও করতেন।

টেকনাফের পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে জাদিমুরা ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের একটি দল ওমর ফারুককে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাকে অন্য জায়গায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তার লাশ উদ্ধার করে।

টেকনাফের জাদিমুরায় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ভাঙচুর চালায় স্থানীয় বাসিন্দারা।

সেই খবরে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে জাদিমুরা বাজারে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে এলাকাবাসী। এ সময় তারা আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে।

বিক্ষোভের মধ্যেই তারা কয়েক দফা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে গিয়ে বিভিন্ন এনজিও-র সাইনবোর্ড, ক্যাম্পের ঘরবাড়ি ও একটি রোহিঙ্গা দোকানে ভাংচুর চালায়। ২৭ নম্বর ক্যাম্পে সেইভ দ্য চিলড্রেনের একটি কার্যালয়ও ভাংচুরের শিকার হয়।

বেলা ১টার দিকে শিশু-কিশোরসহ উঠতি বয়সীদের একটি দলকে লাঠিসোঁটা নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দিকে যেতে দেখা যায়। ক্যাম্পের ভেতরে ভাংচুর না করলেও বিভিন্ন এনজিওর সাইনবোর্ড ও স্থাপনায় লাঠি চালিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় তাদের।

বেলা ১টার দিকে পুলিশের হস্তক্ষেপে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেন বিক্ষোভকারীরা।

তাদের একজন মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজেদের জায়গায় রোহিঙ্গাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল ফারুকরা। সবসময় তাদের হয়েই কাজ করত। আজ তারাই ফারুককে হত্যা করেছে।”

টেকনাফের জাদিমুরায় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ভাঙচুর চালায় স্থানীয় বাসিন্দারা।

যুবলীগ নেতা ওমর ফারুকের পরিবার জাদিমুরা এলাকায় প্রভাবশালী। তাদের প্রায় ১৪ একর জমিতে রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার এখন বসবাস করছে বলে জানান ফারুকের বাবা আবদুল মোনাফ।

’ইতে রোহিঙ্গারে বালা গইত্তো’

ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের আবাসনের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ক্যাম্পের অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন ফারুক। তিনি এভাবে খুন হওয়ায় রোহিঙ্গারাও বিব্রত।

যখন গুলি করে হত্যা করা হয়, তখন শ্রমিকদের দিয়ে রাস্তার উপর থেকে ইট সরানোর কাজ তদারক করছিলেন ফারুক।

তার সঙ্গের শ্রমিকদের একজন ছিলেন রোহিঙ্গা শরণার্থী মোহাম্মদ ইউসুফ। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

ইউসুফ সাংবাদিকদের বলেন, “সেনাবাহিনীর গাড়ি যাবে, এ কারণে আমাদের নিয়ে ইট সরাতে যান তিনি। প্রথমে কাজের জায়গায় কয়েকটা গুলি করা হয়। এরপর আরেক জায়গায় নিয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়।”

ঘটনার সময় ২০-৩০ জন ‘সন্ত্রাসীর’ মধ্যে কয়েকজনের হাতে অস্ত্র ছিল বলে জানান ইউসুফ।

রোহিঙ্গা শরণার্থী তোফায়েল আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওমর ফারুক গম মানুষ আইছিল, ইতে রোহিঙ্গারে বালা গইত্তো। ইতে হনদিনি রোহিঙ্গারে হারাপ কিছু ন গইত্তো “

যে জায়গায় ফারুককে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে কয়েক মিটারের মধ্যে তোফায়েলের ঘর। শুক্রবার সকালে বিক্ষোভ-অবরোধ ও ভাংচুরের সময় রোহিঙ্গারা ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বলে জানান তিনি।

’রোহিঙ্গা দিয়া মারাইয়ে’

রোহিঙ্গাদের দায়ী করে এলাকাবাসী ভাংচুর-অবরোধ করলেও ছেলের হত্যাকাণ্ডের জন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন ফারুকের বাবা আবদুল মোনাফ, যিনি এলাকায় মোনাফ কোম্পানি হিসাবে পরিচিত।

‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ’ রোহিঙ্গা ‘সন্ত্রাসীদের’ দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে অভিযোগ করে মোনাফ বলেন, “আমার ছেলেরে রোহিঙ্গারা মারেনি, রোহিঙ্গাদের দিয়ে মারাইয়ে।”

টেকনাফের জাদিমুরায় যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শুক্রবার বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ভাঙচুর চালায় স্থানীয় বাসিন্দারা।

৭৫ বছর বয়সি মোনাফ বলেন, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন ফারুক। গত ঈদে এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার বের করেছিলেন। তখন থেকে তার প্রতিপক্ষরা বিভিন্ন রকম ‘ষড়যন্ত্র’ করছিল।

“ডাকাতদের মুখোমুখি অনেকবার হয়েছিল ফারুক। ডাকাতরা মারলে আরো আগেই মারত,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ফারুকের বাবা।

ঘটনার পর এলাকাবাসী রোহিঙ্গা নেতা আবদুর রহমান, মোহাম্মদ মাচনকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানান মোনাফ। তবে তাদেরকে গ্রেপ্তার কিংবা আটকের কথা স্বীকার করেনি পুলিশ।