ঈদে খুশি নেই, খুনিদের ফাঁসি চান রিফাতের মা

ঈদ যখন মানুষের কাছে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসছে, রিফাতের শোকে তাদের বাড়িতে তখন কেবলই বিষাদের সুর। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা ডেইজি বেগম এখন বিছানায় শুয়ে বা রিফাতের কবরের পাশে কেঁদে সময় কাটান।

মনির হোসেন কামাল বরগুনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2019, 10:51 AM
Updated : 11 August 2019, 12:14 PM

রিফাতের প্রিয় খাবার নুডলস বা কাবাব আর রান্না করেন না তার বোন ইসরাত জাহান মৌ। শোকসন্তপ্ত পরিবার সামলাতে গিয়ে কান্না চেপে রাখতে হয় রিফাতের বাবা দুলাল শরীফকে। তাই পুত্রশোকে তাকে হয়ে থাকতে হয় পাথর।

গত ২৬ জুন একদল লোক বরগুনা শহরে রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে (২৩)। রিফাত সদর উপজেলার বড় লবণগোলা গ্রামের দুলাল শরীফের ছেলে। হত্যা দৃশ্যের ভিডিও সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

এ ঘটনায় মামলা চলছে মামলার মত। কিন্তু রিফাতের স্বজনরা কেমন আছেন, সম্প্রতি সেই খবর নিতে লবণগোলা গ্রামে তাদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, সুনসান নীরবতা চারদিকে।

রিফাতের মা ডেইজি বেগম ঈদ স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার বাবা কোরবানিতে রুটি খাইতো। কলিজা ভুনা খাইতো। আহারে আমার বাবা। আমার বাবারে হারাইয়া আমি…বাবায় আমারে নিজের হাতে খাওয়াইতো। আমি অসুস্থ হইলে আমার পাশে বইস্যা কত্ত যত্ন করত।”

ডেইজির কাছে সেসব এখন কেবলই স্মৃতি। কিছুতেই তিনি মানতে পারছেন না যে রিফাত নেই।

তিনি বলেন, “আমি অপেক্ষায় থাকি, রিফাতের মোটরসাইকেলের শব্দ এই বুঝি ভেসে এল। মনের অজান্তেই বলে ফেলি, ‘মৌ (নিহত রিফাতের ছোট বোন), মা, দরজা খোল, রিফাত আসছে’।”

তিনি রিফাতের হত্যাকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে বলেন, “আমার ছেলেরে যারা কুপিয়ে মেরেছে, তাদের কেউ যেন রেহাই না পায়। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার দেখে মরতে চাই। খুনিদের ফাঁসি চাই।”

কথা বলতে বলতে ফের কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

রিফাতের বোন ইসরাত জাহান মৌ বরগুনা সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজের সেই গেট মাড়িয়েই তাকে ক্লাসে যেতে হয়, যে গেটের সামনে তার ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ভাইয়ের কথা মনে করে মৌ বলেন, “প্রত্যেকবার কোরবানির দিন সকালে ভাইয়া আমার হাতের নুডুলস খেয়ে নামাজ পড়তে যেত। সকালে উঠেই বলত, ‘মৌ, নুডুলস রান্না কর।’ আমি রান্না করে দিতাম। নুডুলস খেয়ে নামাজ পড়তে যেত।

“নামাজ পড়া শেষে বাবা-চাচাদের সঙ্গে গরু জবাই করে মাংস নিয়ে ফিরে বলত, ‘মৌ, কাবাব বানা। তোর হাতের রান্না করা নুডলস আর কাবাব আমার খুব পছন্দ।’ আমি জানতাম আমার ভাইয়া আমার হাতের নুডলস আর কাবাব পছন্দ করত। খুব যত্ন করে বানিয়ে যখন ওর সামনে দিতাম, ভাইয়া নিজের হাতে মা ও আমাকে খাইয়ে দিত।”

মৌ বলেন, “ভাইয়ার মৃত্যুর পর আমিও নুডলস আর কাবাব খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কারণ ভাইয়ার এ দুটো খাবার খুব পছন্দ ছিল। ভাইয়ার পছন্দের খাবার আমার সামনে এলে আমি খেতে পারি না।”

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রিফাতের বোন মৌ।

তিনি বলেন, “আমরা দুই ভাইবোন আর মা আর বাবা—এই চারজনের সংসারটা ছিল এক টুকরো সুখের ছবি। আমার মা অসুস্থ। তবু প্রতিদিন ভাইয়ার কবরের পাশে গিয়ে তিন-চার ঘণ্টা কান্না করেন। বিছানায় হঠাৎ করেই কখনও ডুকরে, কখনও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তকে কী সান্ত্বনা দেব, কে সান্ত্বনা দেবে বলুন।

“সান্ত্বনা শুধু এতটুকুই হতে পারে--আমার ভাইকে যারা মেরেছে, আমি দ্রুত তাদের গলায় ফাঁসির দড়ি দেখতে চাই।”

রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ পুত্রশোকে কিছুটা যেন পাথরই হয়ে আছেন। একদিকে ছেলে হারানোর শোক বইছেন নিজে, অপরদিকে রিফাতের মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল গোটা পরিবারকেও দেখতে হয় তাকেই। তাই চাইলেও তিনি কাঁদতে পারেন না। তবু চোখের জল কার কথা শোনে যেন! রিফাতের প্রসঙ্গে জানতে চাইতেই তিনি কেঁদে ওঠেন।

“ঈদে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করত রিফাত। আমি ওরে সেলামি দিতাম। ওর শখ ছিল পাঞ্জাবি ও একজোড়া জুতো। এর বেশি কিছু কখনও চাইত না। বাবা-ছেলে মিলে একসাথে ঈদের নামাজে যেতাম, ফিরে একসাথে সবাই খেতে বসতাম। ও নেই, আমার তো আসলে অবশিষ্ট আর কিছু নেই।”

কথা বলতে বলতে তার চোখের পাতা ভারি হয়ে ওঠে। দু ফোঁটা জল চোখের কোণ গড়িয়ে মাটিতে পড়ে। বেশি কথা বলতে পারেন না দুলাল শরীফ। তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে। তবু কান্না চেপে তিনি বলেন, “ছেলেকে তো আর ফেরত পাব না। হত্যাকারীদের বিচার দেখতে পারলে কেবল আত্মার শান্তি।”

বড় লবণগোলা এলাকায় বাড়িতে প্রবেশপথের বাঁ পাশের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে রিফাতের মরদেহ। সন্ধ্যায় বাড়িটি থেকে বের হয়ে আসার সময়ও কানে ভেসে আসে রিফাতের মায়ের আহাজারি, “আরে আমার বাবা। আমার বাবায় কই হারাইয়া গ্যালো। তোমরা আমার বাবারে আইন্যা দেও।”

নিহত রিফাত শরীফ

রিফাত হত্যার ঘটনায় মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

আর গ্রেপ্তার হয়েছেন রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি।

রিফাতকে রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার সময় স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়।

পরদিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন; তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকে।

পরে মিন্নির শ্বশুর তার ছেলের হত্যাকাণ্ডে পত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করলে আলোচনা নতুন দিকে মোড় নেয়।

গত ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক মিন্নিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষে মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানায়।

তবে বরগুনা সরকারি কলেজের এই স্নাতকের ছাত্রী ইতোমধ্যে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে।

তার বাবার অভিযোগ, নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মিন্নিকে ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে’ পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তার দাবি।

বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত এবং জেলা ও দয়েরা জজ আদালতে মিন্নির জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তার আইনজীবীরা। কিন্তু তাতেও তারা ব্যর্থ হন।