সাঁওতালপল্লীতে আগুন-গুলি: অভিযোগপত্রের প্রতিবাদ অব্যাহত

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালপল্লীতে অগ্নিসংযোগ ও গুলিতে হত্যার মামলায় অভিযোগপত্র থেকে এজাহারভুক্ত আসামিকে বাদ দেওয়ায় সাঁওতালরা ফের বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে।

গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 July 2019, 05:36 PM
Updated : 30 July 2019, 05:39 PM

পরে তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর লেখা একটি স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিয়েছেন।

সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

ঘটনার দুই বছর আট মাস পর তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) গাইবান্ধা ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল হাই সরকার গত রোববার গোবিন্দগঞ্জ জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে এই অভিযোগপত্র জমা দেন।

এতে গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুল আহম্মেদ শাকিল, একই ইউনিয়নের ইউপি সদস্য শাহ আলম ও আইয়ুব আলী, চিনি কলের (জিএম-অর্থ) নাজমুল হুদা ও চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান দুলালসহ ৯০ জনকে আসামি করা হয়।

অভিযোগপত্র থেকে এজাহারভুক্ত আসামি সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে বাদ দেওয়ায় ওইদিনও সাঁওতালরা অভিযোগপত্র প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ করেছিল।

অপরদিকে, একই সময়ের ঘটনায় দায়িত্ব পালনকালে হামলায় পুলিশ সদস্য আহত হওয়ায় পুলিশ বাদী মামলায় একই দিন ৩৯ জন সাঁওতালকে আসামি করে একই আদালতে আরেকটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই-এর পরিদর্শক মোহাম্মদ জুলফিকার আলী ভুট্টু এই অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

গোবিন্দগঞ্জ সাঁওতাল পল্লী মাদারপুর থেকে মঙ্গলবার সকালে বিক্ষুদ্ধ সাঁওতাল নেতাকর্মীরা ফেস্টুন ও পতাকা নিয়ে গাইবান্ধা শহরে এসে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে মানববন্ধন শেষে শহরের ডিবি রোডের ১ নম্বর ট্রাফিক মোড়ে এক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়।

সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম-ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মিহির ঘোষ, আদিবাসী বাঙালী সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু, জেলা বাসদ সমন্বয়ক গোলাম রব্বানী, সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম-ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম প্রধান, সাঁওতাল হত্যার মামলার বাদী থমাস হেমব্রম, আদিবাসী নেত্রী রোমেলা কিসকু, ভিজিলিয়াস প্রমুখ।

সমাবেশে ফিলিমন বাস্কের অভিযোগ করে বলেন, ঘটনার প্রায় তিনবছর পর দেওয়া অভিযোগপত্রে ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত এজাহারভুক্ত আসামি গোবিন্দগঞ্জ আসনের সাবেক (ওই সময়ের) সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, চিনিকলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল আউয়াল, গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন ফকু, সাবেক (ওই সময়ের) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান, উপজেলার কাটাবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক ও প্রকাশ্যে সাঁওতালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগকারী পুলিশ সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত আগুন লাগানোর ফুটেজ, ছবি প্রকাশ পেলেও পিআইবির তদন্তকারী কর্মকর্তারা তা এড়িয়ে গেছেন। এ থেকে অনুমিত হয় পুলিশ প্রভাবিত হয়ে এই অভিযোগপত্র দিয়েছেন। তাই তারা এই অভিযোগপত্র প্রত্যাখ্যান করেছেন।

সাঁওতাল হত্যার মামলার বাদী থমাস হেমব্রম বলেন, “পিবিআই-এর তদন্ত প্রতিবেদন ও অভিযোগপত্র তাদের মনগড়া। এর বিরুদ্ধে আমরা আদালতে নারাজি দেব। যারা ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে রয়েছেন, পুলিশ বাদী অপর একটি মামলায় তাদেরকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় অন্য এলাকার সাধারণ মানুষকেও আসামি করা হয়েছে।

“এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান-পিবিআই কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ মিথ্যা অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। আমর এ চার্জশিট মানি না।”

আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, “ঘটনার সময় অগ্নিসংযোগের দৃশ্যমান ফুটেজ, চাক্ষুষ সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকার পরও যে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে, তাতে আমরা সংক্ষুব্ধ।”

১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকল কর্তৃপক্ষ সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তোলে।

কিন্তু ওই জমি ইজারা দিয়ে ধান ও তামাক চাষ করে অধিগ্রহণের চুক্তিভঙ্গ করা হচ্ছে অভিযোগ করে দখল ফিরে পেতে কয়েক বছর আগে আন্দোলনে নামে সাঁওতালরা। এক পর্যায়ে গত ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তারা সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমিতে কয়েকশ ঘর তুলে বসবাস শুরু করে।

ওই বছর ৬ নভেম্বর চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে। দফায় দফায় সংঘর্ষের মধ্যে সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালালে চারজন সাঁওতাল তাতে আহত হন। তাদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়। পরে পুলিশ ওই বসতি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে।

হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুট ও উচ্ছেদের ঘটনায় মুয়ালীপাড়া গ্রামের সমেস মরমুর ছেলে স্বপন মুরমু ওই বছর ১৬ নভেম্বর অজ্ঞাতনামা ৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এছাড়া ২৬ নভেম্বর ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতাল টমাস হেমব্রম আরেকটি মামলা করেন, যেখানে ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে ৬০০ জনকে আসামি করা হয়।

ওই ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় রোববার পিবিআই অভিযোগপত্র দেয়, যেখানে ৯০ জনকে আসামি করা হয়। দুই মামলার তদন্ত একসঙ্গে করে পিবিআই আদালতে এই অভিযোগপত্র জমা দেয়।