বন্যা: গাইবান্ধায় কৃষির ব্যাপক ক্ষতি

বন্যায় গাইবান্ধায় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

তাজুল ইসলাম রেজা গাইবান্ধা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 July 2019, 05:47 PM
Updated : 29 July 2019, 05:47 PM

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, দুই সপ্তাহের বেশি সময় পানির নিচে থেকে প্রায় ১৪ হাজার ২১ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল ও আমন বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। তার মধ্যে ৭ হাজার ৫১৯ দশমিক ৯০ হেক্টর জমির ফসল ও আমন বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে।

এদিকে, সোমবার জেলার সবকটি নদ-নদীর পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অনেক এলাকা থেকে পানি নেমে গেছে। কিন্তু ৩৭টি বাঁধ ও অসংখ্য সড়ক ভেঙ্গে ঘরবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে অনেক এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও পানিতে ডুবে আছে।

পানি নেমে যাওয়া এলাকার লোকজন বাড়ি ফিরতে গিয়ে ধসে যাওয়া ঘরবাড়ি সংস্কার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব তাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। পাশপাশি খাদ্য সমস্যাও ও চলতি আমন মৌসুমে ধানের ক্ষেতে চারা রোপন নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন কৃষকরা। ঘরে রাখা খাদ্যশস্য, মাঠের ফসল ও আমন বীজতলা নিমজ্জিত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

তাই জেলার বন্যাদুর্গত এলাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারগুলোও অনেকটা ত্রাণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। 

গাইবান্ধা-বালাসী সড়কের ফুলছড়ির রসুলপুর এলাকায় আশ্রয় নেওয়া খাদিজা বেগম বলেন, রসুলপুর গ্রামে তার বাড়িতে এক বুক সমান পানি উঠে ধান-চাল সব পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ায় পর সোমবার উদ্ধার করতে গিয়ে দেখে পচে গেছে।

একই এলাকায় আশ্রিত প্রান্তিক কৃষক আয়তাল হক বলেন, “আমন ধানের বিছনের কাচলাগুলা (বীজ তলা)  সব নষ্ট হয়্যা গেল বাহে। বন্যা পানিত খ্যায়া (নষ্ট) গেছে। ওয়া (ধানের চারা) গাড়মু (রোপণ করব) ক্যাংকা (কী) করি। আমন ধান এবার আর গাড়বার পারব্যার নই। ট্যাকা-পয়সাও নাই যে ওয়া কিনিয়া আনিয়া গাড়মু।”

ফুলছড়ির বালাসী ঘাটে প্রস্তাবিত বাস স্ট্যান্ডের উপর বানের পানিতে ভেজা ধান শুকাচ্ছিলেন করিমন বেগম (৪০)। বস্তায় থাকা অবস্থায় ভিজে গিয়েছিল ধানগুলো। তাই চারা গজিয়ে গেছে। পাশেই আধা পচা ভুট্টা শুকাতে দিয়েছেন আনোয়ারা বেগম। নাকে আসছিল ধান ও ভুট্টার পচা গন্ধ।

করিমন বেগম বলেন, “এই ভিজে যাওয়া ধান-ভুট্টা শুকাইতিছি; এগলা খাইয়্যাই হামরাগুল্যাক বাঁচি থাকার চেষ্টা করান নাগবে। আমন  ধানের বেছনের কাছলাও (বীজতলা) ডুবি গ্যাচে। আর ফসল পামু কিনা তার ঠিক নাই।”

ফুলছড়ির উড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুর চরের কৃষক আবেদ আলী বলেন, বন্যার পানিতে তার পাট ও ভুট্টার ক্ষেত ডুবে গিয়ে সব পচে গেছে। সরকারি সহায়তা ছাড়া এ অবস্থায় তার আর কিছুই করার নাই।

ফুলছড়ির উদাখালী গ্রামের আনছার আলী বলেন, “হঠাৎ বন্যায় সব ভাসি গেছে বাহে। বানটা এমন করি আইল। জীবন বাঁচানোই দায় হয়্যা পড়ছিল। ধান-চাল সব ঘরের মধ্যে, ঘরোত বুক সমান পানি। সোক পচি শ্যাষ।”

এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করার দাবি জানিয়ে গাইবান্ধা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক দীপক কুমার পাল বলেন, এই সময় কৃষি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরদের পাশে না দাঁড়ালে জেলায় আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।

জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম গোলাপ বলেন, সরকার কৃষকদের পাশে না দাঁড়ালে শুধু আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নয়, জেলায় ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।

জেলা সিপিবি সভাপতি মিহির ঘোষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে শুধু সার-বীজ-কীটনাশক সরবরাহই নয়; পুরোনো কৃষি ঋণ মওকুফ এবং সহজ শর্তে নতুন করে কৃষি ঋণ প্রদানের দাবি জানান।

জেলার একাধিক কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, নদী এলাকায় বন্যা হলে পানি দ্রুত নেমে যায়। কিন্তু গাইবান্ধায় আকস্মিকভাবে বাঁধ ও সড়ক ভেঙে কৃষিনির্ভর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় পানি নামতে বা শুকাতে কয়েক মাস লাগবে। এই বন্যা কৃষিতে বড় রকমের সংকট সৃষ্টি করবে।

গাইবান্ধা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এস এম ফেরদৌস বলেন, কৃষকের ক্ষতি পোষাতে দ্রুত আমন ধান বীজ সরবরাহ করা হলে আমন উৎপাদন ব্যাহত হবে না।

“এ কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার প্রতিটি ব্লকে ১০ হেক্টর করে আমন বীজতলা স্থাপনের চেষ্টা করছি।” তিনি আরও জানান, বন্যায় জেলায় নষ্ট হয়েচে রোপা আউস ধানের ক্ষেতের পরিমাণ ৩ হাজার ৬১ হেক্টর, পাট ২ হাজার ৩৮৮ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ৪২৩ হেক্টর, আগাম রোপা আমন ধান ৩১ হেক্টর, শাকসবজী ১ হাজার ১৩৫ হেক্টর, পানবরজ ৩ হেক্টর ও অন্যান্য ফসল ৪৬ হেক্টর।