উত্তরের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ 

উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণের ফলে উত্তরের জেলাগুলোর বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে।

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিগাইবান্ধা ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2019, 06:02 PM
Updated : 18 July 2019, 06:02 PM

প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা। পানিবন্দি ও আশ্রয়হীন হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ।

বৃহস্পতিবার গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদ-

গাইবান্ধা

বৃহস্পতিবার সকালে নতুন করে গাইবান্ধা শহরের পার্ক রোড, ডিবি রোড়, পিকে বিশ্বাস রোডে পানি উঠেছে।

ফলে শহরে বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে যে যেভাবে পারে গবাদিপশু আর নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয় নেয় পাউবোর বাঁধে, সড়কে, সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। অনেকে আটকা পড়ে আছে নিমজ্জিত এলাকায় বাড়িতেই।

এছাড়া জেলার চরাঞ্চলে শুরু হয়েছে নৌ-ডাকাতদের উৎপাত।

বৃহস্পতিবার ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ঘাঘটের পানি ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

এখনও সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলরুটে যোগাযোগ চালু হয়নি। বন্যা কবলিত জনপদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

জেলা শহরের সঙ্গে সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ রয়েছে বিচ্ছিন্ন। বুক সমান পনি হওয়ায় গাইবান্ধা-বালাসি সড়কেও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়েছে।

পাঠদান বন্ধ হয়েছে শত শত ও নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পানিবন্দি প্রায় ৪ লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে নয় হাজার ৬০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল।

বিগত ১৯৮৮ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যাকে ছাড়িয়ে যাওয়ায় এবারের এই বন্যাকে গাইবান্ধার বানভাসী মানুষ মহাপ্লাবন বলছে।

এ পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

সদর উপজেলার খোলাহাটী ইউনিয়নের গোদারহাট এলাকার সোহাগ (৫) ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গেন্দুরাম গ্রামের আনোয়ারুল ইসলাম (৩২) বন্যার পানিতে ডুবে এবং সাঘাটার কুন্ডুপাড়ায় উজ্জল কুমার (১৫) সাপের কামড়ে মারা গেছেন।

সরেজমিন দেখা যায়, গাইবান্ধা শহরের পিকে বিশ্বাস রোড, সান্তার পট্টি রোড, স্টেশন রোডের কাচারী বাজার থেকে পুরাতন জেলখানা পর্যন্ত, ভিএইড রোড, ডেভিড কোম্পানীপাড়ার ২টি সড়ক, মুন্সিপাড়া শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়ক, ব্রিজ রোড কালিবাড়িপাড়া সড়ক, কুটিপাড়া সড়ক, পূর্বপাড়া সড়ক, একোয়াস্টেটপাড়া সড়ক, বানিয়ারজান সড়ক, পুলিশ লাইন সংলগ্ন সড়ক হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত।

বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিস, স্কুল কলেজ, প্রধান কাঁচাবাজার ও অধিকাংশ এলাকার বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উঠে পড়ায় বন্ধ করতে হয়েছে বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

দিন হাজিরার বিনিময়ে কাজ করা শ্রমিকরা কাজের অভাবে বেকার হয়ে পড়েছেন। আতঙ্কে শহরের জেগে থাকার ফলে রাস্তাঘাটেও মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। এককথায় মানুষদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

চরাঞ্চলের একধিক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, যে গবাদিপশুগুলো চরাঞ্চলে আটকা পড়েছে সেগুলো যানবাহনের অভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। চরে গত দুই দিন চলে নৌ ডাকাতের উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ রাত জেগে পাহাড়া দেওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয় নাই।

তারা আরও জানান, ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালী ইউনিয়নের সিংড়িয়া, উদখালী, পূর্ব ছালুয়া, কাঠুর, উড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুর ও গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারীতে এখনও অনেক পরিবার চরাঞ্চলে আটকা পড়ে রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির সংকটেও তারা ভুগছে।

গাইবান্ধা পৌর মেয়র শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবীর মিলন বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ত্রাণ সামগ্রী পাওয়া যায়নি। তবে এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের কাছে জরুরিভিত্তিতে ত্রাণ সহায়তার জন্য আবেদন করা হয়েছে।

তবে গাইবান্ধা পৌর এলাকায় ২০টি আশ্রয় কেন্দ্রের সাড়ে ৪ হাজার বন্যার্ত মানুষের মাঝে নিজ উদ্যেগে খাবার প্রদান করছেন বলে তিনি জানান।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান বলেন, গতকাল ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ১৫০ সে.মি., ঘাঘট নদীর পানি ৯৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেলেও এখনও বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। তিস্তার পানিও বিপৎসীমার নিচে চলে গেছে।

গাইবান্ধার বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে ৫টায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক প্রেসব্রিফিং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আলমগীর কবির ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেবুন নাহার জানান, বন্যায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সাদুল্লাপুর ও সদর উপজেলার একটি পৌরসভাসহ ৩৭টি ইউনিয়নের ২৫৩টি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১ লাখ ৪ হাজার ৩৪০, লোকসংখ্যা ৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮। ঘরবাড়ির সংখ্যা ৩৯ হাজার ১৪২। আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে ১৬৬টি। এতে আশ্রয় নিয়েছে ৭১ হাজার ২৪ জন। এছাড়া ২ হাজার ৯৪১টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এ পর্যন্ত ৫৮৫ মে. টন চাল ও ৯ লাখ টাকা এবং ৩ হাজার ৫৫০ কাটুন শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

গাইবান্ধা কৃষি অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এসএম ফেরদৌস বলেন, জেলায় রোপা আউস ধান ক্ষেত ২ হাজার ১৩ হেক্টর, পাট ৫ হাজার ৮০ হেক্টর, আমন বীজতলা ১ হাজার ২৯০ হেক্টর, শাকসবজি ক্ষেত ৬৮০ হেক্টর ও অন্যান্য ক্ষেত ৫৩ হেক্টর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।

গাইবান্ধা রেলস্টেশন মাস্টার আবুল কাশেম বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকল্প উপায়ে ট্রেন চলাচল করছে। গাইবান্ধার বোনারপাড়া রেল স্টেশন থেকে সান্তাহার এবং গাইবান্ধা রেলস্টেশন থেকে লালমনিরহাট ও দিনাজপুরের মধ্যে ট্রেন চলাচল করছে।

“পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত এভাবে ট্রেন চলাচল করবে। সান্তাহার-লালমনিরহাট রেলরুটের গাইবান্ধা সদর উপজেলার বাদিয়াখালি থেকে ত্রিমোহিনী পর্যন্ত রেলপথের প্রায় ৬ কিলোমিটার অংশ ডুবে গিয়ে একাধিক স্থানে স্লিপার পাথর ও মাটি ধসে যাওয়ায় বুধবার থেকে এই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।”

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসেন আলী জানান, গাইবান্ধায় বিদ্যালয়ের মাঠে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় জেলার সাত উপজেলার ৩ শত ২১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৮১টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৮৪টি ও কলেজ ৪টি। সাতটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

কুড়িগ্রাম

কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপূত্র ও ধরলার পানি কমতে শুরু করলেও টানা নয়দিন ধরে পানিবন্দি মানুষ রয়েছে চরম দুর্ভোগের মধ্যে। সীমিত আকারে ত্রাণ শুরু হলেও বেশ কয়েক জায়গার মানুষ ত্রাণ পায়নি বলে জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৭ সে.মি. কমে গিয়ে এখন ১২৫ সে.মি. এবং ধরলা নদীর পানি ১১ সে.মি. কমে গিয়ে ১০৫ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। 

বুধবার রাতে চিলমারী উপজেলার কাচকল এলাকায় বাঁধ ভেঙে পুরো উপজেলা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। একই অবস্থা রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলায়।

তিন উপজেলায় সকল ধরণের কার্যক্রম স্তবির হয়ে পরেছে। কোমড় পানিতে তলিয়ে আছে উপজেলা প্রশাসন, থানা, হাসপাতালসহ গোটা এলাকা। এখন পর্যন্ত বন্যায় ৫৬টি ইউনিয়নের ৫৭৮টি গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে সাড়ে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।

উলিপুরের ধামশ্রেণি ইউনিয়নের মধ্য নাওড়া গ্রামে বাবলু মিয়ার মেয়ে ববিতা খাতুন (১৬) পানি ভেঙে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ডোবা রাস্তা ধরে বাড়িতে যাওয়ার পথে খালে পড়ে তার মৃত্যু হয়।

এনিয়ে গত নয় দিনে জেলায় পানিতে ডুবে মারা গেল ১৪ জন। এরমধ্যে উলিপুরেই মারা গেছে ৮ জন।

বৃহস্পতিবার সরজমিনে সদর উপজেলার যাত্রাপুর ও পাঁচগাছী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল বানবাসীদের দুর্ভোগ। পাঁচগাছী ইউনিয়নের গারুহারা এলাকার টাবুর গ্রাম পুরো তলিয়ে গেছে। এখানে বাণিয়াপাড়াসহ দেড়শ পরিবার বাড়ীঘর ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। গ্রামের একটি উঁচু ভাসমান সড়কে ৪দিন ধরে ৪টি পরিবার অবস্থান করছে।

দুপুরে এই পরিবারের ছয় বছরের ছেলে বাবু লবণ দিয়ে ভাত খাচ্ছিল। তরকারির জন্য কান্নাকাটি করছিল সে। খেতেই চাইছিল না।

একই স্থানে অবস্থান নেওয়া হোসেন আলী, হাছেন আলী, আফসার ও মোয়াজ্জেম বলেন, চারদিন ধরি পড়ে আছেন। কেউ তাদের খবর নেয়নি। কোনো ত্রাণ পাননি তারা।

পার্শ্ববর্তী যাত্রাপুর ইউনিয়নের আরাজী ভোগডাঙ্গা চরের কোরবান আলী একই অভিযোগ করেন, “হামাকগুলাক কাঁইয়ো রিলিফ দেয় নাই।” বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় কোরবান আলীর বাড়িতে ছয়দিন ধরে আশ্রয় নিয়েছেন জরিনা, তার স্বামী জমদ্দি, শ্বশুর খয়বর ও ২ সন্তান। গত ৪ দিন ধরে তারা নৌকায় অবস্থান করছেন। ঘরের ভিতর গলা পানি। রাতযাপন করার মতো অবস্থা নেই। চুলা ভিজে যাওয়ায় বিকাল ৩টা পর্যন্ত রান্না হয়নি।

জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম জানায়, বন্যার ফলে ৫৬টি ইউনিয়নের ৫৭৮টি গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩শ’ পরিবারের সাড়ে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৪৯ ঘরবাড়ি। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বন্যায় ৩২ কিলোমিটার বাঁধ, ৭২ কিলোমিটার কাঁচা ও ১৬ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বন্যায় ৭৫৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ৪ ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে ১৫ হাজার ১৬০ হেক্টর। জেলার ২১টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩৫ হাজার ৬৪৪জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।