রবিউলের স্বপ্ন পূরণেই বাঁচতে চায় পরিবার

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার রাতে নিহত পুলিশ কর্মকর্তা রবিউল করিমের স্বজনরা তার স্বপ্নের মধ্যে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। নিজেরাও খুঁজে নিতে চান বেঁচে থাকার শক্তি। 

শফিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2019, 05:37 PM
Updated : 30 June 2019, 05:38 PM

মৃত্যুর তিন বছরে স্বজন হারানোর সেদিনের পরিস্থিতি অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন।

রবিউলের স্বপ্ন ছিল শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন শিশু ও কিশোরদের জন্য একটি বিশেষায়িত বিদ্যালয়, একটি বৃদ্ধাশ্রম এবং একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। এখন পরিবারের সদস্যরা তার সেই অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান।

রবিউলের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর আগের দিন রোববার কথা হয় রবিউলের স্ত্রী উম্মে সালমার (৩৬) সঙ্গে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রবিউলের শূন্যতা তো সারা জীবন থেকে যাবে। কিন্তু ওই দুঃস্বপ্নের ঘটনার পরে সবার সহযোগিতায় নিজেদের অনেকটা সামলে নিয়েছি। এখন ছেলে-মেয়েকে মানুষ করা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি আর রবিউলের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন নিয়ে কেটে যায় সময়।”

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করে জঙ্গিরা। হামলার সময় জঙ্গিদের ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খান।

স্বামীর স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে সালমা জানান, প্রতিবন্ধী শিশুদের খুব ভালোবাসতেন রবিউল। সেই ভালোবাসা থেকে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন শিশু ও কিশোরদের জন্য বাড়ির অদূরে মানিকগঞ্জের বাসাই গ্রামে ২০১১ সালে রবিউল প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিকনিং লাইট অরগানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি (ব্লুমস)’ নামে একটি বিশেষায়িত বিদ্যালয়।

বাবার ছবি হাতে রবিউলের সন্তান

বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ৪২ জন প্রতিবন্ধী শিশু লেখাপড়া করছে জানিয়ে সালমা বলেন, “স্কুলটি আবাসিক করা এবং সেখানে একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করাও তার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর স্কুলটিকে আর আবাসিক করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন ব্যক্তির অনিয়মিত কিছু অনুদানে কোনোরকমে চলছে বিদ্যালয়টি। আর বৃদ্ধাশ্রম করা তো আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

নিজের একার পক্ষে সম্ভবপর নয় উল্লেখ করে রবিউলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আবেদন জানান সালমা।

ঢাকার ধামরাই উপজেলার দেপাশা গ্রামের মোহাম্মদ শাহজাহানের মেয়ে সালমার সঙ্গে ২০০৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা রবিউলের বিয়ে হয়। সালমা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।

আর রবিউলের লেখাপড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলায় স্নাতকোত্তর করে বিসিএস দিয়ে পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

তিন বছর আগে নজিরবিহীন ওই হামলার মাসখানেক পর জন্ম হয় রবিউলের দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে কামরুন্নাহার রায়নার। আর রায়নার বড় ভাই সাজিদুল করিম সামির বয়স এখন নয় বছর। দুই ভাই-বোনই পুলিশের ইউনিফর্ম পরা রবিউলের ছবিতে খুঁজে ফেরে বাবাকে।

সালমা বলেন, “বড় ছেলে সামি এমনিতেই চাপা স্বভাবের। বাবার মৃত্যুর পর থেকে আরও বেশি চুপচাপ আর গম্ভীর হয়ে গেছে। কেবল মাঝেমধ্যে আমাকে বলে, বড় হয়ে সে বাবার মতো হতে চায়।”

আর মেয়ে রায়নাকে নিয়ে সালমা বলেন, “ও তো বাবার স্পর্শ পায়নি। তবে আমার মনে হয় বাবা জিনিসটা কী তা সে ফিল করতে পারে। ছবির অ্যালবাম থেকে ইউনিফর্ম পড়া বাবার সব ছবি খুঁজে দিতে পারে সে। সেসব ছবি দেখে বাবাকে সালাম দেয়। আর কখনো বা এসে আমাকেই বাবা বলে ডাকে।”

সালমা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ২০১৭ সালে

হলি আর্টিজানে হামলার এক বছর পরে ২০১৭ সালে সালমাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের শিক্ষা শাখায় এডহক ভিত্তিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বছর সে চাকরি স্থায়ী হয়েছে জানিয়ে এজন্য তিনি বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

রবিউলের ছোট ভাই শামসুজ্জামান শামস (৩৩) ভাতিজা-ভাতিজিকে দেখভাল করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামি তো খুব কম কথা বলে। ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে আরও চুপ হয়ে গেছে। আর রায়নাও বাবাকে খুব মিস করে। বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি বাসায় গেলে কাটা চামচ দিয়ে আম তুলে এনে আমাকে বলল- কাকা খাও।”

রবিউলের মৃত্যুর পরে মা করিমুন্নেসাও স্থায়ী অসুস্থতায় পড়েছেন বলে জানালেন শামস। 

“ভাইয়ার মৃত্যুর পর আমাদের মা করিমুন্নেসা মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। এখন মেরুদণ্ড আর হাড়ের সমস্যায় ভুগছেন তিনি।”

বড়ভাই রবিউল করিমের একটা হাসপাতাল করারও ইচ্ছা ছিল জানিয়ে ভবিষ্যতে সে স্বপ্নও বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবেন বলে জানান শামস।

“আপাতত আমি ভাইয়ের স্কুলটা নিয়ে কাজ করছি। পাশাপাশি নিজে ছোটখাট একটা ব্যবসা দাঁড় করাবার চেষ্টা করছি। ভাইয়ের অবশিষ্ট স্বপ্নগুলো বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা চালিয়ে যাব।”

তবে এসব কিছুর পাশাপাশি গুলশান হত্যাকাণ্ডের মামলার গতি নিয়ে হতাশার কথা জানালেন রবিউলপত্নী সালমা।

তিনি বলেন, “ওই ঘটনার তিন বছর পার হয়ে গেছে। অথচ এখনও একটা বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলো না। আমরা তো ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। আর বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা এই ক্ষত আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই এসব বিচার আরও দ্রুত করা উচিত।”

“আমি চাই এরকম ঘটনা শুধু বাংলাদেশে না, পৃথিবীর কোথাও আর না ঘটুক। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।”