শাবির ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে ‘শঙ্কা’

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উন্নয়ন প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে ‘শঙ্কা’ দেখা দিয়েছে; যাতে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

হোসাইন ইমরান, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2019, 03:00 PM
Updated : 26 June 2019, 03:03 PM

‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর উন্নয়র প্রকল্প’ নামে সাড়ে ৩ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের বরাদ্দ ২শ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

প্রকল্পের সময় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

বর্তমানে এই প্রকল্পের সময়সীমা আড়াই বছর পার হয়ে গেলেও কাজ হয়েছে মোট প্রকল্পের মাত্র আড়াই শতাংশ। মেয়াদ অনুযায়ী আগামী ১ বছরে এই প্রকল্পের বাকি সাড়ে ৯৭ শতাংশ কাজ করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছেন শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অনেকেই।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারলে মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পের কাজ বহাল রাখবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই।

অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ২০১৭ সালের ১৭ অগাস্ট। তার দায়িত্ব গ্রহণের সাত মাস আগে থেকেই এই প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয়েছিল। ইতিমধ্যে তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় ২০ মাস পার হয়ে গেলেও এই উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।

সাড়ে ৩ বছর মেয়াদী এই উন্নয়ন প্রকল্পের জানুয়ারি ২০১৭ থেকে এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত কাজের একটি হিসাব বিবরণী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে হাতে এসেছে।

হিসাব বিবরণীতে দেখা যায়, ছাত্রীদের জন্য চার তলাবিশিষ্ট একটি আবাসিক হল, ছাত্রদের জন্য চার তলা বিশিষ্ট সৈয়দ মুজতবা আলী হল বর্ধিতকরণ, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্য পাঁচ তলা বিশিষ্ট দুইটি ডরমেটরি, দুইটি একাডেমিক ভবন বর্ধিতকরণ, দুই তলা বিশিষ্ট একটি ওয়ার্কশপ, পাঁচ তলা বিশিষ্ট সেন্টার অব এক্সিলেন্স ভবন, সীমানা প্রাচীর, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র, লিফট স্থাপনসহ বহুমুখী উন্নয়ন কাজ ছিল এই প্রকল্পের অধীনে।

হিসাবে দেখা যায়, গত আড়াই বছরে এই প্রকল্পে শুধু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ (চলমান), বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও রাসয়নিক দ্রবাদি ক্রয়, ভূমি উন্নয়ন এবং প্রকাশনা কাজে মাত্র প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে, যা মোট প্রকল্পের আড়াই শতাংশ।

আবাসিক হল, শিক্ষকদের ডরমেটরি, একাডেমিক ভবন নির্মাণসহ অবকাঠামোগত কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রায় ১৯৪ কোটি ৯৬ লাখ ৫০ হাজার টাকাই রয়ে গেছে অব্যবহৃত, যা মোট প্রকল্পের সাড়ে ৯৭ শতাংশ।

খরচ হওয়া ৫ কোট ৪১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে সীমানা প্রাচীর নির্মাণে (বরাদ্দকৃত ৫ কোটি ১১ লক্ষ টাকা) প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও রাসয়নিক দ্রবাদি ক্রয় বাবদ প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা, ভূমি উন্নয়ন বাবদ প্রায় ৯ লাখ টাকা এবং প্রকাশনা বাবদ প্রায় ৫১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

১৯৮৬ সালের পহেলা ফাল্গুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর দীর্ঘ ৩৩ বছরে শাবিতে ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হল রয়েছে মাত্র ৫টি (একটি অপূর্ণাঙ্গ), একাডেমিক ভবন ৬টি, শিক্ষক-কর্মকর্তার থাকার ভবন রয়েছে একটি। প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন।

স্থান সঙ্কটের কারণে অনেক বিভাগ সুষ্ঠুভাবে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। কখনও কখনও কয়েকটি বিভাগ পর্যায়ক্রমে একই রুমে ক্লাস করে থাকে। ল্যাব না থাকার কারণে অনেক বিভাগ তাদের গবেষণা কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না।

২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে এসে ২শ কোটি ৩৮ লাখ টাকার প্রকল্পের বরাদ্দের কথা বলেছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সে সময় উপাচার্য ছিলেন আমিনুল হক ভূইয়া।

ওই বছরেই এই প্রকল্প শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত হয়ে একনেক থেকে পাস হয়। তখন এই প্রকল্পের মেয়াদ দেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

বিগত আড়াই বছরে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে না পারার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছিল বলে মনে করছেন শিক্ষক, কর্মকর্তাদের অনেকেই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, প্রকল্পের আড়াই বছর মেয়াদ চলে গেল, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো কাজই শুরু হয়নি। এর পেছনে কর্তৃপক্ষের গাফিলতি রয়েছে। কাজ শুরু হলে পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো যেত। মেয়াদ চলে গেলে মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পের কাজ চালাবে কিনা তা পুরোটাই শঙ্কার মধ্যে। কেননা অতীতে অনেক প্রকল্পের মেয়াদ চলে যাওয়ায় টাকা ফেরত নিয়েছে মন্ত্রাণালয়।

আগামী এক বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের বাকি ৯৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ হাবিবুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একটি ৪ তলা ভবন তৈরি করতে সাড়ে ৪ বছর সময় লাগে। সেখানে এই প্রকল্পে কতগুলো ভবন। এক বছরে তা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে।

“যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়, যে সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। কাজ শুরু করে পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হয়।”

তবে কেন বিগত আড়াই বছর সময়ের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের প্রধান এ কে ফেরদৌস বলেন, “কনসালটেন্ট নিয়োগ পেতে দেরি হয়েছে। আমরা ৯টা মিটিং এ বসেছি, কিন্তু কনসালটেন্ট পাইনি।”

তাহলে এই প্রকল্প নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা কী প্রশ্ন করা হলে ফেরদৌস বলেন, “আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সচিবের সাথে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে বসব। সেখানে প্রজেক্ট ইনক্রিমেন্টের বিষয়ে আলোচনা করব।”

তবে এই প্রকল্প সময়মতো শুরু না হওয়ার অন্য কারণ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে ব্যাখ্যা করছেন একাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১ হাজার কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প একনেক থেকে অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন। উপাচার্য সেই প্রকল্পে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ২শ কোটি ৩৮ লাখ টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু করেননি।

তবে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের কনসালটেন্ট নিয়োগ হয়ে গেছে। ই-টেন্ডার, সয়েল টেস্ট করাও হয়ে গেছে। খুব শিগগির কাজ শুরু হবে।”

বিগত আড়াই বছরে কেন কাজ শুরু হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের লোকবলের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। আমরা সার্বিক দিক দেখছি। লোকবলের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”

মেয়াদজনিত বিষয়ে এই প্রকল্প কোনো শঙ্কার মধ্যে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলব। এর মেয়াদ বাড়াব। এতে চিন্তার কিছু নেই।”