মানব পাচার: সিলেটে এনামুলসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকায় গ্রেপ্তার এনামুল হকসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে সিলেটে।

সিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2019, 10:28 AM
Updated : 17 May 2019, 10:28 AM

অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে নিহত আব্দুল আজিজের ভাই মফিজ উদ্দিন বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ওসি আবুল বাসার মোহাম্মদ বদরুজ্জামান বলেন, মানবপাচার এবং আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলাটি করা হয়েছে।

সিলেটের রাজা ম্যানশনের নিউ ইয়াহিয়া ওভারসিজের মালিক গোলাপগঞ্জ উপজেলার পনাইরচক গ্রামের এনামুল হক, একই উপজেলার হাওরতলা গ্রামের ইলিয়াস মিয়ার ছেলে জায়েদ আহমেদ, ঢাকার রাজ্জাক হোসেন, সাইফুল ইসলাম, মঞ্জুর ইসলাম ওরফে গুডলাক ও তাদের ১০-১৫ জন অজ্ঞাতপরিচয় সহযোগীকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।

ফেঞ্চুগঞ্জের মুহিদপুর গ্রামের মফিজ উদ্দিন বলেছেন, তার ছোট ভাই আব্দুল আজিজকে ইতালি পৌঁছে দেওয়ার জন্য আট লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল।

গত বছরের ৪ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ১০ মে পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আসামিরা নানাভাবে তার কাছ টাকা আদায় করে।

এরপর আজিজ ও আরো কয়েকজনকে লিবিয়ায় আটকে রেখে মারপিট করা হয় এবং দেশে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয় বলেও অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।

লিবিয়ার জুয়ারা থেকে অবৈধভাবে ইতালিতে যাওয়ার পথে গত ১০ মে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকা ডুবে বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

ওই নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ ৩৯ বাংলাদেশির একটি তালিকা সরকারের পক্ষ প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের লাশ উদ্ধারের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে এসেছে অনেকটাই।

নিহত ও নিখোঁজদের মধ্যে অন্তত ২২ জনের বাড়ি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। চারজনের বাড়ি ফেঞ্চুগঞ্জে।

এদিকে সিলেটে মামলা হওয়ার পর রাতেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এনামুল, রাজ্জাকসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাবের এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এনামুল ১০/১২ বছর ধরে মানবপাচারে জড়িত। আর রাজ্জাক গত চার-পাঁচ বছর ধরে তার দালাল হিসেবে কাজ করছিলেন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ এই অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত আছে। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি বিদেশি চক্রের যোগসাজশে অবৈধভাবে ইউরোপে লোক পাঠিয়ে আসছে।”

মানব পাচারের এই কাজটি তিনটি ধাপে করা হয় জানিয়ে এই র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, কারা অবৈধভাবে বিদেশে যেতে আগ্রহী, তাদের বাছাই করা হয় প্রথম ধাপে। তারপর তাদের বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পাঠানো হয়। পরে লিবিয়া থেকে আরেকটি চক্রের মাধ্যমে পাঠানো হয় ইউরোপে।

“এই চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে।ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়।”

পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট কেনাসহ যাবতীয় সব কাজ এই চক্রের মাধ্যমে হয় জানিয়ে মুফতি মাহমুদ বলেন, “এ জন্য এক একজনের কাছ থেকে সাত থেকে আট লাখ টাকা তারা নিয়ে থাকে। এর মধ্যে সাড়ে চার বা পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়া যাওয়ার আগেই দিতে হয়। লিবিয়া যাওয়ার পর বাকি টাকা আত্মীয়দের কাছ থেকে নেওয়া হয়।”

এই ‘মানব পাচার চক্রটি’ বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে তিনটি রুট ব্যবহার করে থাকে বলে জানানো হয় র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে।

সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়া, বাংলাদেশ থেকে ভারত, শ্রীলংকা হয়ে ট্রানজিট ব্যবহার করে ইস্তাম্বুল হয়ে লিবিয়া এবং বাংলাদেশ থেকে দুবাই ও জর্ডান হয়ে লিবিয়ার ত্রিপলি থেকে ইউরোপে লোক পাঠানো হয়।

ত্রিপলিতে কথিত ‘গুডলাক ভাই’ তাদের দায়িত্ব নেয়। সেখানে তাদের কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ওই সময় দেশে পরিবারের কাছ থেকে চুক্তির বাকি টাকা আদায় করা হয়।

“এরপর ত্রিপলির বন্দর এলাকায় একটি সিন্ডিকেটের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয় ইউরোপে পাচারের জন্য। সেখানেও টাকা লেনদেন হয়।”

মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ওই সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে নৌযান চালনা, সমুদ্রে দিক নির্ণয় যন্ত্র ব্যবহারসহ কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে নৌকায় তুলে দেয় পাচারের শিকার মানুষগুলোকে। তিউনিশিয়া চ্যানেল হয়ে ইউরোপের দিকে রওনা দেয় তারা। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাওয়ার সময় ভূমধ্য সাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।