বরগুনায় পরিত্যক্ত ভবনে চলছে শিশুদের পাঠ

ছাদ ভেঙে শিশু শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পরও বরগুনায় শতাধিক পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে এখনও শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

মনির হোসেন কামাল বরগুনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2019, 04:16 PM
Updated : 21 April 2019, 04:17 PM

কোনো কোনো স্কুলে খোলা জায়গায়, কোথাও তাঁবু টানিয়ে, আবার কখনও ভাড়া ঘরেও পাঠদান চলছে।

কয়েকটি দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহতের কারণে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

তালতলী উপজেলার ৫ নম্বর ছোটবগী পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ৬ এপ্রিল ক্লাস চলাকালে একটি কক্ষের বিম ধসে পড়ে মানসুরা আক্তার নামে তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রী নিহত হয়। আহত হয় রুমা, সাদিয়া, ইসমাইল, রোজমা ও শাহীন নামে আরও পাঁচজন।

এরপর ৯ এপ্রিল সকালে ক্লাস শুরুর কিছুক্ষণ আগে বরগুনা শহরের আমতলা সড়কে অবস্থিত ১৬ নম্বর মধ্য বরগুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের একটি বিমের একাংশ ভেঙে পড়ে।

এ ঘটনায় কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

এর একদিন পর (১০ এপ্রিল) আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া জগৎচাঁদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের ছাদের একাংশ ও বিম ভেঙে পড়ে। সকাল ৯টার দিকে এ ঘটনায় কোনো হতাহত হয়নি।

বরগুনা জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের হিসাব অনুযায়ী জেলার ৮০১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ১০৮টি পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ।

এরমধ্যে সদর উপজেলায় ২২৯টির মধ্যে ১৩টি, আমতলীতে ১৫২টির মধ্যে ৩৭টি, তালতলীতে ৭৮টির মধ্যে ১৮টি, পাথরঘাটায় ১৪২টির মধ্যে ২১টি, বামনায় ৬৩টির মধ্যে ৬টি এবং বেতাগী উপজেলায় ১৩৭টির মধ্যে ৭টি ভবন পরিত্যক্ত।

তবে পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ বিদ্যালয়ের পুর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এম এম মিজানুর রহমান।

ছোটবগী পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৯৬৯ সালে স্থাপিত হয়। এখানে ২০০২ সালে একটি নতুন ভবন নির্মাণ করে স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগ কর্তৃপক্ষ, যা ২০০৪ সালে হস্তান্তর করে নির্মাণাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেতু এন্টারপ্রাইজ।

বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির অভিযোগ, ভবনটি নির্মাণের এক বছরের মাথায় গ্রেড বিমে ফাটল ধরে। এরপর মাঝে মধ্যে কোনোভাবে সংস্কারের মাধ্যমে ভবনটিতে চলে আসছিল শিক্ষা কার্যক্রম।

এ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও সাবেক কাউন্সিলর সাইফুল ইসলাম শামীম বলেন, বিদ্যালয় ভবনটি দীর্ঘদিন যাবত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও নতুন ভবন নির্মাণের ব্যাপারে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই উদাসীনতার কারণেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। যার ফলে বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদের পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন অভিভাবকরা।

আমতলীর হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া জগৎচাঁদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শহিদুল্লাহ বলেন, চার কক্ষের স্কুলটির একটি অফিস ও অপর তিনটি শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি কক্ষের বিমে ফাটল ধরেছে। ছাদ ধসে পলেস্তারা খসে পড়ছে। এ অবস্থায় ছাত্র ছাত্রীদের ঠিকমতো পাঠদান করানো যাচ্ছে না।

“ভবনের ছাদ ও দেয়াল থেকে পলেস্তারা ধসে পড়ায় ও পানি চুইয়ে পড়ায় শিক্ষক ও  শিক্ষার্র্থীদের ভয় ও আতংকের মধ্যে ক্লাস করতে হয়।

২০০১-০২ সালে  এলজিইডির অর্থায়নে স্কুলভবনটি নির্মাণ করা হয়।

সদর উপজেলার পূর্ব ঢলুয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ে রড বেরিয়ে গেছে। ফাটল ধরেছে দেয়াল এবং গ্রেট বিমে।

ঝড়ের সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আতঙ্কে থাকে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার এমএম মিজানুর রহমান বলেন, যেখানে যেখানে সমস্যা হচ্ছে সেখানে সাময়িকভাবে জরুরি মেরামতের মাধ্যমে পাঠদান চালু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে যেসব বিদ্যালয় ভবন পরিত্যক্ত অথবা ঝুঁকিপূর্ণ আছে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সেগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে।

অল্প সময়ের মধ্যে এসব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব বলে তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।

বরগুনার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এএসএম কবির বলেন, “বরগুনা জেলা উপকূলবর্তী হওয়ায় লবণাক্ততা ও আবহাওয়ার কারণে ভবনগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।”

তাছাড়া এ ভবনগুলো নির্মাণের পর শিক্ষা বিভাগ থেকে স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে ভবন রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য যে অর্থ দেওয়া হয় তা দিয়ে সঠিকভাবে কাজ করতে না পারার কারণেও দ্রুতই ভবনগুলো নষ্ট হয়ে যায় বলে তিনি মত দেন।

বরগুনা-১ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, ১৪/১৫ বছরের ভবন ভেঙে পড়ে, এটার সাথে তৎকালীন শিক্ষা প্রশাসন, এলজিইডি ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জড়িত। যেহেতু ঠিকাদার ছিল সাবেক সংসদ সদস্যের ভাগ্নে। তারা যে নিম্নমানের কাজ করেছেন তা এখন স্পষ্ট।

খুব শিগগিরই ওখানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। একইসঙ্গে পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে তিনি জানান।