সিংহের ডেরায় হট্টিটির সংসার

খাঁ খাঁ রোদে খোলা মাঠে চারটি ডিমের উপর বসে তা দিচ্ছে স্ত্রী হট্টিটি পাখি, পাশে খাবার খুঁটে খাচ্ছে পুরুষ হট্টিটিটি; আর এই দম্পতির সংসারে কোনো রকম বাগড়া না দিয়ে আশেপাশে ১৫টি সিংহ, কেউ আয়েশে শুয়ে আছে, কেউবা রাজকীয় চালে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2019, 01:36 PM
Updated : 8 April 2019, 04:46 PM

গত বৃহস্পতিবার গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের কোর সাফারি অংশে দেখা গেল প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে রাখা সিংহের এলাকায় খড়কুটো জড়ো করে এক জোড়া হট্টিটির সংসার।

এই প্রাকৃতিক বেষ্টনিতে মোট ১৫টি সিংহের বাস। অথচ পশুরাজ সিংহের সঙ্গে কোনো বিরোধ দেখা গেল না লম্বা পা-ওয়ালা পাখি দুটির। বরং মনে হচ্ছিল, সিংহ যেন তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে মানুষের কাছ থেকে।

পরিদর্শক বহনকারী গাড়িটি যখন এই এলাকার ভেতর দিয়ে চলছিল, তখন মানুষবাহী যানটি দেখে পাখি দুটি বাসা ছেড়ে কিছু দূরে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে। এই পথে প্রতিদিন পরিদর্শকবাহী বাস চলাচল করলেও মানুষের প্রতি যেন তাদের ভয় কাটেনি।   

বাসটি সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে ভেতরে থাকা যাত্রীদের পাখি ও সিংহের আচরণ খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ মেলে। 

স্ত্রী হট্টিটি পাখিটি একবার বাসা ছেড়ে হেঁটে হেঁটে কয়েক ফুট দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকছে। আর কিছুক্ষণ পর পর জোরালো কণ্ঠে ডাকছে ‘হট্টিটি হুট - হট্টিটি হুট’।

এরপর আবারো খড়ের বাসায় ফিরে এসে তা দিতে বসছে। বাসটি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকায় যেন পাখি জোড়ার অস্থিরতা কাটছিল না। বাসা ও ডিমের দিকে ছিল তাদের তীক্ষ্ণ নজর।

ডিম রক্ষায় হট্টিটি পাখি বিশেষ কৌশলী হয় বলে জানালেন সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ, সহকারী বন সংরক্ষক মো. তবিবুর রহমান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে তিন ধরনের হট্টিটি পাখি দেখা যায়। তার মধ্যে লাল লতিকা হট্টিটি অন্যতম। অন্যান্য পাখির মতো তারা গাছে বাসা বেঁধে ডিম দেয় না। এরা নির্জন খোলা মাঠে ডিম দিয়ে থাকে।

“তারা মাঠের যে জায়গায় ডিম দেয় সেই জায়গার সঙ্গে ডিমের রঙটা এমনভাবে মিশে যায় যে কোনো শিকারি প্রাণি তা বুঝতেই পারে না যে সেখানে ডিম আছে কি না। আর যেখানে ডিম আছে সেখানে কোনো শিকারি প্রাণি গেলে তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য একটু দূরে গিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে। তখন শিকারি প্রাণিটি চলে যায়। এভাবে তারা তাদের ডিম রক্ষা করে।”

অন্যান্য পাখির মতো হট্টিটি পাখির ডিমে বেশিক্ষণ তা দিতে হয় না। এরা সাধারণত এপ্রিল-জুলাই মাসে ডিম দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে এসময় যে তাপমাত্রা থাকে তাতেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।

এক সময় বাংলাদেশের সব জায়গাতেই হট্টিটি পাখির বিচরণ ছিল। এখন প্রজনন এবং আবাসস্থলের অভাব হওয়ায় কমে এসেছে এদের সংখ্যা।

এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রজাতিটি বিলুপ্ত হতে পারে এমন উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন পাখি বিশেষজ্ঞরা।

বংশ রক্ষার জন্য ঝোপঝাড়পূর্ণ মাঠের মত উন্মূক্ত স্থান হলে এবং প্রজননের সময় এদের বিভ্রান্ত না করলে পাখিটির বংশ বৃদ্ধি ও টিকে থাকা সম্ভব।

হট্টিটির দেহের তুলনায় পা দুইটি বেশ লম্বা। মাথায় ঝুটি ও প্রশস্ত ডানা রয়েছে। এদের লাল লতিকা, ধূসর ও সাদা পালকের পাখিটির পা দেহের তুলনায় বেশ লম্বা এবং হলুদ রংয়ের হয়।

কারাড্রাইডাই গোত্রের পাখিটির ইংরেজি নাম ল্যাপউইং।

এদের ঠোঁট এবং চোখের সামনের অংশ লাল হয়। এরা কীট-পতঙ্গ, ক্ষুদ্র অমেরুদণ্ডী প্রাণি, বীজ, ছত্রাক, ব্যাঙ-ব্যাঙাচি খেয়ে থাকে।

সাফারি পার্কে বেশ কিছু হট্টিটি পাখি রয়েছে বলে জানালেন তবিবুর রহমান।

এই কর্মকর্তা বলেন, “এ পার্কে নিরাপত্তা ও অনুকূল পরিবেশ ফিরে পাওয়ায় এক সময় এ এলাকা ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন পাখি আবার এখানে ব্যাপকভাবে ফিরে আসছে।

“ধীরে ধীরে এ পার্কটি অভয়ারণ্যে পরিণত হচ্ছে এবং এখানে জীববৈচিত্র্যের সমাবেশ ঘটছে।”

থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের সাফারি পার্কের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরের ইন্দ্রপুর (বাঘেরবাজার) এলাকায় তৈরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক চালু হয় ২০১৩ সালে।

তিন হাজার ৬৯০ একর জমির উপর ২৬৩ কোটি টাকা খরচে নির্মিত এ পার্কটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় সাফারি পার্ক বলে দাবি করেন এর কর্তৃপক্ষ।

এখানে বাঘ ও সিংহের বেষ্টনিতে সাফারি বাস ও জিপে করে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণরত বাঘ, সিংহ ও ভল্লুক দেখা যায়।

বাঘ-সিংহ ছাড়াও এই পার্কের মুক্ত পরিবেশে বাস করছে হরিণ, কুমির, জেব্রা, জিরাফসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রাণি ও পাখি।