মাছে মিষ্টিতে পোড়াদহের মেলা

শহুরে বাঙালির বসন্ত বরণের নানা আয়োজনের মধ্যেই সনাতন পঞ্জিকা মতে ইছামতির তীরে পোড়াদহে হয়ে গেল জমজমাট মাঘ সংক্রান্তির মেলা।

জিয়া শাহীন বগুড়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Feb 2019, 07:49 AM
Updated : 14 Feb 2019, 07:49 AM

বগুড়া শহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে পোড়াদহের এই মেলায় ভিড় করেছিলেন আশপাশের কয়েক জেলার মানুষ।

প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার ঐতিহ্যবাহী এ মেলা বসে পোড়াদহে। এবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সূর্যোদয়ের পর থেকেই মেলামুখী সব সড়কে মানুষের ঢল নামে।

প্রতি বছরের মত এবারও সবার দৃষ্টি ছিল নানা প্রজাতির বড় বড় মাছ আর নানান রকম মিষ্টির দিকে। মেলায় বসা আসবাবের দোকানগুলোতেও বিক্রি হয়েছে দেদার।

পোড়াদহের মেলা এক দিনের হলেও আশপাশের গ্রামে তিন দিন ধরে চলে ‘জামাই উৎসব’। মেলায় ওঠা বড় মাছ আর মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় এলাকার জামাইদের। উপহার হিসেবে তাদের জন্য কেনা হয় কাঠের আসবাব।

বৃহস্পতিবার একই জায়গায় বসেছে ‘বউ মেলা’। নতুন বউদের জন্য চুড়ি, ফিতা, গয়না আর রূপচর্চার উপকরণে সাজানো হয়েছে মেলার দোকানগুলো।

পোড়াদহের মেলা উপলক্ষে বাবার বাড়িতে নাইওর আসা নারী আর স্থানীয় নববধূরাই ‘বউ মেলা’র প্রধান ক্রেতা।

মহিষাবান এলাকার ৭০ বছরের বৃদ্ধ সুভাশীষ জানালেন, প্রায় দেড়শ বছর আগে পোড়াদহ এলাকায় এসে এক মরা বটগাছের নিচে আসন নিয়েছিলেন এক হিন্দু সন্ন্যাসী। তার স্মরণেই প্রতি বছর পোড়াদহের এ মেলার আয়োজন।

স্থানীয়ভাবে প্রচলিত লোককথা হল, সেই সন্ন্যাসীর দীর্ঘ সাধনার পর মৃত বটগাছটি আবার সবুজ হয়ে উঠেছিল। এ কারণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে পোড়াদহের মেলা ‘সন্ন্যাস মেলা’ নামেও পরিচিত।

প্রতি বছর যেখানে মেলা বসে, সেখানে বোরো আবাদের কারণে এবার মেলা বসেছিল সামান্য দূরে কাতলাহার বিলের পাশের নিচু জমিতে। এ বছর মেলা আয়োজনের দায়িত্বে ছিল পোড়াদহ সার্বজনীন পূজা কমিটি।

বরেণ্য কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার 'খোয়াবনামা' উপন্যাসে এই কাতলাহার বিলের কথাই লিখে গেছেন। সেই বিল শুকিয়ে বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে এখন ধান ক্ষেত। স্থান পরিবর্তন হলেও এবার মেলায় লোক সমাগম ছিল আগের মতই।

পোড়াদহের মেলায় এবার সবচেয়ে বড় মাছটি ছিল ৭০ কেজি ওজনের একটি বাঘাইড়। গোলাবাড়ি এলাকার জেলে বিফল মণ্ডল সারিয়াকান্দির যমুনা নদী থেকে মাছটি ধরে মেলায় নিয়ে এসেছিলেন।

প্রতি কেজি এক হাজার ৫০০ টাকা হিসেবে মাছটির দাম তিনি চাইছিলেন ১ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। দুপুর পর্যন্ত এককভাবে কেউ মাছটি কিনতে না পারায় পরে কেটে কেজি দরে বিক্রি করা হয় মাছটি।

তবে পাশের দোকানে শরফাত আলীর কাছ থেকে ৪০ কেজি ওজনের আরেকটি বাঘাইড় ৪৬ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছেন নওগাঁর ব্যবসায়ী মোসারব হোসেন।

পোড়াদহের মেলায় এই প্রথমবার এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি এই মেলার কথা অনেক শুনেছি। এখানে অনেক বড় বড় মাছ পাওয়া যায় শুনেই এসেছি। ওজনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় বড় মাছটি কিনলাম। খুব ভালো লাগছে।”

বাঘাইড়ের পাশাপাশি রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল, বোয়ালসহ অর্ধশত প্রজাতির মাছ কেনা-বেচা হয়েছে এবারের মেলায়। আকার ভেদে প্রতি কেজি রুই ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, কাতলা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, বোয়াল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।

তবে মাছের মেলায় ক্রেতার চেয়ে দর্শক বেশি ছিল। অনেকে মোবাইল ফোনে মাছের সঙ্গে সেলফিও তুলেছেন।

মাছের পরে এ মেলার বড় অকর্ষণ হল মিষ্টি। কোনো কোনো মিষ্টির আকার আবার মাছের মত। সেই মিষ্টি বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে। আট কেজি ওজনের একটি মাছ-মিষ্টি পাঁচ হাজার টাকায় কিনে নিয়ে গেছেন একজন ক্রেতা।

মেলায় কাঠের আসবাবপত্রের দোকানগুলোতেও কেনা-কাটায় ব্যস্ত ছিলেন অনেকে। নানা ধরনের আচার; কৃষি সামগ্রী; গরু, মহিষ ও খাসির মাংস; পিঁয়াজ ও মরিচসহ যাবতীয় মশলার পসরা যেমন ছিল, বিনোদনের জন্য ছিল সার্কাস, নাগরদোলা, যাদু প্রদর্শনী, কাঠ, বাঁশ আর মাটির তৈরি খেলনা, পুতুল, রঙ- বেরঙের বেলুন।

মা-বাবার সঙ্গে মেলায় আসা বগুড়া বিয়াম মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী নাফিস আব্দুল্লাহ বড় বড় মাছ আর মিষ্টি দেখে দারুণ খুশি। সে জানালো, এত বড় মাছ আর এত্ত মিষ্টি সে আগে কখনও দেখেনি। মেলাটা অনেক মজার।

সিরাজগঞ্জের ইসমাইল হোসেন জানালেন, গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিবারই তিনি পোড়াদহের মেলায় আসছেন।

“বড় বড় মাছ আর মিষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে। তবে আগের মত জ্যান্ত মাছ আর দেখি না। এখন ফ্রিজে রাখা মাছ আনা হয়।”

পোড়াদহের এই মেলা স্থানীয় বাসিন্দাদের সমাজ জীবনে করটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝা গেল গোলাবাড়ি এলাকার আছিয়া সুলতানার কথায়।

“মেলা উপলক্ষে জামাইদের দাওয়াত দেওয়া বাধ্যতামূলক। ঈদে দাওয়াত না করলেও জামাইরা মন খারাপ করে না, কিন্তু মেলায় না ডাকলে তারা কষ্ট পায়।”

মেলার আয়োজক পোড়াদহ সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শঙ্করকুমার রায় বলেন, “সামাজিকভাবে এই মেলার গুরুত্ব অনেক বেশি। এ মেলাকে ঘিরে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি পেশার মানুষের সমাগম ঘটে ।”

বগুড়া লেখক চক্রের সভাপতি ইসলাম রফিক পোড়াদহের মেলাকে বর্ণনা করলেন এ অঞ্চলের মানুষের ‘প্রাণের মেলা’ হিসেবে।

তিনি বলেন, “আমাদের এই গ্রামীণ মেলাগুলো বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ। পোড়াদহের মেলার জৌলুস হয়ত আগের মত নেই। কিন্তু মেলা ঘিরে এখন এ অঞ্চলের ঘরে ঘরে আনন্দ-উৎসব ছড়িয়ে পড়ে।”

স্থান পরিবর্তন করে কাতলাহার বিলের পাশে মেলা বসায় স্থানীয় সাহিত্যপ্রেমিদের কাছে পোড়াদহের মেলা এবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে স্মরণের উপলক্ষ্য হয়ে উঠেছে বলেও জানান তিনি।