গরু জব্দ করা নিয়ে সংঘর্ষ, বিজিবির গুলিতে নিহত ৩

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরে গরু জব্দ করা নিয়ে সংঘর্ষের মধ্যে বিজিবির গুলিতে তিনজন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

দিনাজপুর প্রতিনিধিঠাকুরগাঁও ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2019, 10:27 AM
Updated : 13 Feb 2019, 01:23 PM

হরিপুর থানার ওসি মো. আমিরুজ্জামান জানান, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের বহরমপুর গ্রামে এ ঘটনায় আরও অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।

নিহতরা হলেন- বকুয়া ইউনিয়নের রুহিয়া গ্রামে নজরুল ইসলামের ছেলে নবাব (৩০) ও জহিরুলের ছেলে সাদেক মিয়া (৪০) এবং বহরমপুর গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী জয়নাল।

আহতদের মধ্যে চোখে গুলিবিদ্ধ আবুল কাসেম নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে রংপুর মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকি ১৪ জনকে ভর্তি করা হয় দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

এরা হলেন জয়বুন নেছা, আব্দুল হান্নান, রুবেল, সাদেক, সাদেকুল, এরশাদি, আনছারুল, মিঠু, বাবু, মুন নাহার, সোহেল রানা, তৈয়বুর রহমান, মুন্নাত আরা ও রাফেল। এদের সকলের বাড়ি বহরমপুর গ্রামে।     

ওসি বলেন, “সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশ যাওয়ার পর বিজিবি সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়।”

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এলাকাবাসী লাশ ঘিরে বিক্ষোভ করছে এবং ঘটনার জন্য দায়ী বিজিবি সদস্যদের শাস্তি দাবি করছেন।

এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মর্তুজার রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আহতদের সকলেই গুলিবিদ্ধ এবং এদের মধ্যে পাঁচ জনের অবস্থা আশংকাজনক।”

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহরমপুর গ্রামের এক ব্যক্তি সকালে গরু নিয়ে যাদুরানী বাজারের উদ্দেশে বের হন বিক্রি করার জন্য। ওই গরু পাচার করে আনা হয়েছে সন্দেহে বেতনা ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা তা জব্দ করতে গেলে এলাকাবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে।

অন্যদিকে বিজিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতীয় গরু আটক করায় সশস্ত্র চোরাকারবারিরা হামলা করলে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হন। 

ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মো. মাসুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওগুলো ভারতীয় গরু। সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা কোনো এক সময় সেগুলো নিয়ে এসেছিল। তারা বাজারে নিয়ে যাওয়ার সময় সীমান্তের দুই কিলোমিটার ভেতরে আমাদের টহল দল তাদের ধরে। গরুগুলো বিওপিতে নেওয়ার সময় দুই তিনশ লোক ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়।

“আমরা প্রথমে ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। তাতে আমাদের অস্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কয়েকজন আহত হয়েছে। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দিয়েও বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় আমরা গুলি করতে বাধ্য হই।”

এদিকে গুলিতে হতাহতের খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিম দুপুরে বহরমপুর গ্রামে যান।

ঘটনাস্থলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “চোরাই গরু ঢুকেছে সন্দেহে বিজিবি অভিযান চালায়। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি গরু জব্দ করে। তখন গ্রামবাসীর সঙ্গে বিজিবির সংঘর্ষ বাঁধে এবং গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। “

এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি করেছে জানিয়ে তিনি  বলেন, “প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

গুলি আত্মরক্ষার্থে: বিজিবি

গুলিতে তিনজন নিহতের ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে মঙ্গলবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি কর্মকর্তারা বলেন, ‘আত্মরক্ষার স্বার্থে’ গুলি চালাতে হয়েছিল।

রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঠাকুরগাঁও বিজিবির লেজার ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে একথা বলেন ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ।

তিনি বলেন, সকালে গোপন সংবাদ পেয়ে হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের বহরমপুর গ্রামে অভিযান চালায় বেতনা বিওপির একটি টহল দল। এসময় চোরাকারবারিদের কাছ থেকে পাঁচটি ভারতীয় গরু জব্দ করা হয়।

“গরুগুলোকে একটি গাড়িতে করে বেতনা বিওপিতে আনার সময় ৬০/৭০ জন চোরাকারবারি সংঘবদ্ধ হয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়। তারা জোরপূর্বক বিজিবির টহল দলের কাছ থেকে ভারতীয় গরুগুলো নামিয়ে নেওয়া চেষ্টা করে।”

বাধা দিতে গেলে চোরাকারবারিরা নায়েব হাবিবুল্লাহ, ল্যান্স নায়েব দেলোয়ার, সিপাহি মুসাহিদ, হাবিবুর, বায়রুল ইসলামের উপর হামলায় চালায় বলে জানান লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন। তিনি বলেন, তারা ঠাকুরগাঁও বিজিবি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল বলেন, “আত্মরক্ষার্থে ও সরকারি সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রথমে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে চোরাকারবারিদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। এতেও তারা শান্ত হয়নি। এসময় চোরাকারবারিরা বিজিবির অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য টানা হেঁচড়া করার এক পর্যায়ে বিক্ষিপ্ত কিছু গুলিবর্ষণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এতে ৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে বলে আমরা জেনেছি।”

নিহতরা চোরাকারবারে সঙ্গে জড়িত কি না- এ প্রশ্নে বিজিবি কর্মকর্তা বলেন, “নিহতরা অবশ্যই চোরাকারবারি দলের সঙ্গে জড়িত, নাহলে তারা কেন রাস্তার মাঝ পথে পরিকল্পিতভাবে বিজিবির টহল দলের উপর আক্রমণ করল। 

“এটি একটি বিরল ঘটনা। এখানে বিজিবির সদস্যদের হতাহত করার জন্য উদ্দেশ্যেমূলকভাবে কারও না কারও ইন্ধনে কিংবা বিজিবির সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে থাকতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।”

লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন বলেন, গত এক মাসের কম সময়ে সীমান্তে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটার পর তারা কড়াকড়ি আরোপ করেছেন।

“ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন চোরাকারবারি গ্রুপগুলোসহ আরও কিছু স্বার্থন্বেষী মহল থাকতে পারে, যারা তাদের ইন্ধন দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বিজিবি সদস্যদের হতাহত করার চেষ্টা করেছে বলে আমাদের ধারণা।”

সংবাদ সম্মেলনে ঠাকুরগাঁও বিজিবির সেক্টর কমান্ডার সামশুল আরেফিনসহ বিজিবির অন্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।