‘সন্তানদের মানবিক শিক্ষা দেওয়া খুব প্রয়োজন’

নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে যাদের একদিন তিল তিল করে মানুষ করেন সেই সন্তানরা যখন মা-বাবাকে অসহায় অবস্থায় ঘরের বাইরে পাঠায় সে কষ্টের ক্ষত কখনও শুকায় না।

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Sept 2018, 04:20 PM
Updated : 30 Sept 2018, 05:48 PM

দিনরাত স্মৃতিচারণ করা যায়, কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেওয়া যায়; কিন্তু ফিরে পাওয়া যায় না হারিয়ে যাওয়া সেই আনন্দ-বেদনার দিনগুলো, যেসব দিনে কষ্ট করেও ছেলে-মেয়েদের মানুষ করার মাঝে নিজের ওই জীবনের একটি সুখ খুঁজে নিয়েছিলেন আজকের অসহায় বাবা-মা।  

যে মা-বাবা নিজের সক্ষম সময়ে জীবনের সঞ্চয় দিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে কিনে দিয়েছেন জমি-জিরেত; পরম মমতায় সবকিছু দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন; বৃদ্ধ বয়সেও ছেলের এক কথায় লাখ লাখ টাকার ব্যাংক চেক কেটে দিয়েছেন শেষ বয়সে তারা থাকছেন স্বজনহীন বৃদ্ধ নিবাসে। এসব বাবা-মায়ের খোঁজ করার প্রয়োজনও ছেলে-মেয়েদের হয় না।

তাই কোনো এক ব্যথিত মায়ের আর্দ্র আকুতি- আইন করে অধিকার আদায় নয়, আজ সন্তানদের মানবিক শিক্ষা দেওয়া খুব প্রয়োজন। 

সিরাজুল ইসলাম (৬৮) ছিলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার। সংসারে ছিল স্ত্রী ও চার মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখে কাটছিল জীবন। কিন্তু চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর পরই দেখা দেয় স্ত্রী-সন্তানদের বীভৎসতা ফুটে ওঠে।

অর্থকষ্ট, অবিশ্বাস, স্বার্থের দ্বন্দ্ব প্রভৃতি স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয় বৃদ্দ সিরাজুলকে। এক সময় তারা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং তাকে মৃত দেখিয়ে সনদ নিয়ে ব্যাংকে জমানো জীবনের সব সঞ্চয় তুলে নিয়ে যায় স্ত্রী-সন্তানরা।

এখন গাজীপুরের বিকে বাড়ির বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র তার ঠিকানা।

প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

দিনটিকে সামনে রেখে শনিবার বিকে বাড়ির বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা হয় সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তার জীবনের নানা তিক্ততার কথা বলে যান একে একে।

তাদের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এলাকায়। চাকরির সুবাদে বসবাস করতেন ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশে একটি ভাড়া বাড়িতে। সেখানেই স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে থাকতেন। স্ত্রীর পরামর্শে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুরের আতলরা এলাকায় শ্বশুরবাড়ি কাছে সম্পত্তি কেনেন স্ত্রীর ও মেয়ের নামে। এ কারণে নিজের ভাই-বোনদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতিও হয়।

২০০২ কি ২০০৩ সালে অবসরে যাওয়ার পর বাড়ি ভাড়া ও সংসার খরচ চালানোর মতো আর্থিক অবস্থাও ছিল না তার। তাই চাকরি নেন ঢাকায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক অফিসে। সেখানে ইনফরমেশন কাউন্টারে কাজ করতেন।

২০০৪ সালের একটি ঘটনা স্ত্রী-মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত নড়বড়ে করে দেয়। তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে সেখানে নার্স নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলে এক নারী আবেদনকারী সিরাজুলের ব্যাগে আবেদনপত্র ও ছবি রেখে যান এবং ভুলে তা তার বাসায় চলে যায়। পরে ব্যাগ খুলে তার স্ত্রী ওই নারীর ছবি দেখার পর তাদের মধ্যে কলহ শুরু হয়। সেখান থেকে তারা আর বের হয়ে আসতে পারেননি।

এর জের ধরে একদিন তার স্ত্রী ঠিকানা নিয়ে ওই তরুণীর বাসায় গিয়ে তাকে গালাগাল দিয়ে আসেন। বাড়িতে ফিরে সিরাজুলকে দা দিয়ে কোপাতে তেড়ে যান। বাইরে কোনো কাজে দেরি হলেই সন্দেহ করতেন, ঝগড়া শুরু করতেন। তাকে ঘরের বাইরে রেখে দরজা বন্ধ করে দিতেন।

একদিন তার স্ত্রী অফিসে যাওয়ার সব জামা-কাপড় কেটে ফেলে দেয় যাতে তিনি অফিসে না যেতে পারেন। পরে অনেকে পুরানো কাপড় খুঁজে নিয়ে সেন্ডেল যোগাড় করে অফিসে যান। টের পেয়ে সেখানেও তার ছোট মেয়ে ও স্ত্রী গিয়ে তাকে গালিগালাজসহ নানাভাবে অপমান করে আসেন।

এক পর্যায়ে অফিস থেকে তিনি তার এক ফুপাত ভাই গিয়াস উদ্দিনের ঢাকার ভাষানটেকের বাসায় চলে যান এবং তাকে সব খুলে বলেন। তিনি বিষয়টি সুরাহা করতে না পারায় সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি ছোট ভাই সফিউদ্দিনের কাছে চলে যান।

ইতিপূর্বে পৈত্রিক জমি বিক্রি করে শ্বশুরদের জমি কিনে স্ত্রী-সন্তানের নামে দেওয়ায় ভাইয়েরাও তাকে ভালোভাবে নেয়নি। কিছুদিন যাওয়ার পর ছোটভাইও তার নামে থাকা অবশিষ্ট ১০ কাঠা জমি লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন সিরাজুলকে।

সিরাজুল বলেন, এরও বেশ কয়েকমাস পর ২০০৬ সালে আবার ঢাকার বাসায় ফিরে গেলে স্ত্রী তাকে স্বামী বলে অস্বীকার করেন এবং তার স্বামী মারা গেছেন বলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। সেখান থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়িতে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে এই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন।

“পরে ব্যাংকে আমার টাকা তুলতে গিয়ে জানতে পারি নমিনি থাকা আমার স্ত্রী ও ছোট মেয়ে আমার নামে ডেথ সার্টিফিকেট বানিয়ে ব্যাংকে জমানো আমার জমি-বিক্রির ১০ লাখ ও পেনশনের ১২ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গেছে।”

পরে বিষয়টি ব্যাংক ও বিমান বাহিনীর অফিসে গেলে ঘটনাটি তাকে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন। এখন শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে থেকে আইনি লড়াই করার মতো মানসিক অবস্থা বা শক্তি কোনোটিই তার নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেন।

সিরাজুল ইসলামের মতো এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন কুমিল্লার জাহানারা বেগম (৭৫)। তার জীবনের গল্পও কষ্টের স্মৃতিতে ভরা। 

তিনি এখন ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা রোগে ভুগছেন।

তার স্বামী বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। ৪০ বছর আগে চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে তার স্বামী মারা যান। সব সন্তানের বিয়ে হওয়ার পর যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে।

জাহানারা বলেন, “একদিন ছোট ছেলে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। সেখানেই চলছিল আমার জীবনযাপন। কিছুদিন পর এই ছেলে ও তার স্ত্রী খুব প্রয়োজনের কথা বলে পাঁচ লাখ টাকার ব্যাংক চেকে স্বাক্ষর করে টাকা তুলে নেয়।”

বেশ কিছুদিন পর তারা আবার আট লাখ টাকার চেক দিতে বলে; জাহানার দিতে রাজি না হলে তারা তাকে বকাঝকা শুরু করে এবং বাড়ি থেকে বের করে দেয়, বলেন জাহানারা।

ইতিপূর্বে অন্যদের না দিয়ে শুধু ছোট ছেলেকে টাকা দেওয়ায় অন্য সন্তানদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি দেখা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই হয় এই বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে আছেন চার বছর ধরে।

“সন্তানরা আমাকে ভুলে থাকলেও আমি তো তাদের ভুলতে পারি না। একদিন এই সন্তানদের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছি, দেহের রক্ত পানি করে বড় করেছি। মাটিতে রাখিনি পোকায় কামড়াবে, শীতের মধ্যে সাড়া রাত জেগে থেকে পায়ের উপর রেখে ঘুম পাড়িয়েছি।

“কিন্তু তারপরও তারা কেন পাল্টে যায়?  শুধু আইন করে সন্তান ও বাবা-মায়ের সম্পর্ক টিকে থাকে না। আমি মনে করি সন্তানদের আজ মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা খুব প্রয়োজন।”

সিরাজুল ইসলাম ও জাহানার বেগমের মতো অনেকেই এখানে আছেন যাদের অভিজ্ঞতা ও কষ্টের কথায় মন আর্দ্র হয়ে ওঠে।

গাজীপুর সদর উপজেলায় বিকে বাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল।

তিনি বলেন, বর্তমানে গাজীপুরের বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০৬ জন নিবাসী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০৬ জন পুরুষ এবং ১০০ জন নারী। 

কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবু শরিফ বলেন, ছায়া সবুজে ঘেরা পরিবেশে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে নারী-পুরুষদের বসবাসের জন্য জন্য আলাদা আলাদা ভবন  রয়েছে। এখানে যারা আছেন তাদের কোনো খরচ দিতে হয় না। নিবাসীদের বিনামূল্যে কাপড় ও চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হয়; যার যার ধর্ম পালনের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার নিবাসীদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা, টেলিভিশন, পত্রিকা ও বইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

এখানে যারা আসতে চান তারা চলাফেরায় সক্ষম ও বয়স ৬০ বছর বা বেশি হতে হবে। বছরের বিশেষ দিনগুলোতে এবং খুব প্রয়োজন হলে কেউ চাইলে স্বজনদের কাছে যেতে পারবেন। মৃত্যুর পর এখানেই তাদের দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়।

ঢাকা থেকে এখানে যেতে হলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহসড়কে চলাচলকারী যেকোনো বাসে উঠে গাজীপুর সদর উপজেলার হোপতাপাড়া এলাকায় নামতে হবে। সেখান থেকে রিকশা, অটোরিকশায় অদূরেই বিকে বাড়ির বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে যাওয়া যাবে।