রাজশাহীতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ‘অর্থ আদায়’

গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে সরকারি প্রকল্পে উপকারভোগীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ উঠেছে রাজশাহীর পুটিয়া উপজেলার কয়েকজন ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে।

বদরুল হাসান লিটন রাজশাহী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2018, 02:13 PM
Updated : 4 Sept 2018, 02:13 PM

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ১০ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সরকার থেকে এক লাখ টাকা পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ৩০০ পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকা।

তাদের অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রথমে টাকা দেওয়ার কথা বললেও পরে জানিয়ে দেন যে আসলে তাদেরকে ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে সরকারি টাকায়। এরই মধ্যে কারও কারও আঙ্গিনায় ঘর নির্মাণের কাজ শুরুও হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে সরকারের আওতায় ‘যার জমি আছে ঘর নাই তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ শীর্ষক ‘আশ্রয়ণ-২’ প্রকল্প বাস্তবায়নে উপকারভোগীদের সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনের সুযোগ নেই।

এ প্রকল্পে উপকারভোগী প্রত্যেককে এক কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর করে দেওয়া হবে, যার দৈর্ঘ্য ১৬ ফুট এবং প্রস্থ সাড়ে ১০ ফুট; সঙ্গে থাকবে পাঁচ ফুট প্রস্থের একটি বারান্দা এবং একটি রিং শৌচাগার। টিনের বেড়া ও টিনের চালের ঘরটির মেঝে হবে পাকা।

প্রতিটি ঘর নির্মাণে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ টাকা।

এই প্রকল্পে পুঠিয়া উপজেলায় ১৮৮টি ঘর নির্মাণ করার কথা, যাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।

সরকারি তহবিল থেকে এক লাখ টাকা পাওয়া যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্যের হাতে দুই দফায় সাত হাজার ৬০০ টাকা তুলে দেন বেলপুকুর ইউনিয়নের ক্ষুদ্র জামিরা গ্রামের মোসাজ্জেল হকের স্ত্রী চাঁনবানু।

চাঁনবানু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেলপুকুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য গিয়াস উদ্দিন ও ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মাহবুব হোসেন ঘর করার জন্য এক লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে তার নাম লিখে নেন। এরপর তারা ১০ হাজার টাকা দিতে হবে বলে জানান।

“ওই সময় চার হাজার ৬০০ টাকা বাড়িতেই ছিল। আর তিন হাজার টাকা ধার করে এনে তাদের সাত হাজার ৬০০ টাকা দিয়েছি। বাকি দুই হাজার ৪০০ টাকা দিতে না পারায় তারা কয়েকবার অপমান করেছেনেআমাকে।”

চাঁনবানুর মতো একই অবস্থা গ্রামের আরও অনেকের হয়েছে।

তাদের পাশেই দেখা গেল পরপর কয়েকটি বাড়ির আঙ্গিনায় চলছে ঘর নির্মাণের কাজ। কারও করও ঘর উঠছে বসতবাড়ির আঙ্গিনায়। এই ঘর অনেকেই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন।  

ক্ষুদ্র জামিরা গ্রামের সানাউল্লাহ স্ত্রী লাইলী বেগম বলেন, “তার ঘর আছে, যেটি অর্থাভাবে সংস্কার করতে পারছি না। সরকার ঘর করার জন্য এক লাখ টাকা করে দেবে বলে ১০ হাজার ৬০০ টাকা নিয়েছেন স্থানীয় মেম্বার। মনে করেছিলাম সে টাকা দিয়ে বাড়ি সংস্কার করব; কিন্তু পরে জানতে পারলাম সরকার থেকে ঘর করে দেবে।”

তার বাড়ির আঙ্গিনায় একটি ঘর করে দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।

একইভাবে ক্ষুদ্র জামিরা গ্রামের মৃত তসলেমের স্ত্রী সুকজানের কাছ থেকে ৯ হাজার ৬০০ টাকা, তারিকুলের কাছ থেকে ১০ হাজার ৬০০ টাকা, মৃত রঞ্জুর স্ত্রী জুতির কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা, বাবর উদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে ১০ হাজার ৬০০ টাকা, পশ্চিম জামিরার মৃত শাহীদুলের স্ত্রী রানীর কাছ থেকে ১১ হাজার টাকা, সাইফুল ইসলামের স্ত্রী হিরা বেগমের কাছ থেকে ১১ হাজার টাকা, আব্দুল কুদ্দুসের কাছ থেকে ১১ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলে তাদের অভিযোগ।

টাকা বরাদ্দ নিয়ে আসার জন্য কাগজপত্র তৈরির খরচ এবং কর্মকর্তাদের দেওয়ার নাম করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন সদস্য এ অর্থ নিয়েছেন বলে তাদের দাবি।

বেলপুকুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বদি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেলপুকুর ইউনিয়নে বরাদ্দ এসেছে ১৮৮টি ঘর। এর তালিকা তৈরি করেছেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য গিয়াস উদ্দিন ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাহবুব হোসেন। তারাই তালিকা জমা দিয়েছেন।

“সে তালিকা আমাকে তারা দেখাননি। আমিও শুনেছি প্রায় সবার কাছ থেকে গড়ে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে।”

তবে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড সদস্যরা।

৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাহাবুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শুধু তালিকা প্রস্তুত করে স্থানীয় এমপির কাছে দিয়েছি। এমপি সাহেব ডিও লেটার দিয়ে বরাদ্দ নিয়ে এসেছেন।”

৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন বলেন, উপকারভোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। বিরোধী পক্ষ তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।

পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, সরকারের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ‘যার জমি আছে ঘর নাই তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ ও ‘যার কুড়ে ঘর আছে তার ঘর নির্মাণ’ এই দুই ক্যাটাগরিতে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে ৩০৪টি ঘর নির্মাণের বরাদ্দ এসেছে।

ইউএনও মাহমুদ বলেন, এর মধ্যে রয়েছে বেলপুকুর ইউনিয়নে ১৮৮টি, বানেশ্বর ইউনিয়নে ৫৫টি ও জিউপাড়া ইউনিয়নে ৬১টি ঘর। প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ এসেছে। গত ১১ জুন প্রকল্প পরিচালক এ বরাদ্দ অনুমোদন করেন। ইতোমধ্যেই এসব ঘর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।

ইউএনও মাহমুদ আরও বলেন, “উপকারভোগী দুস্থদের কাছ থেকে ঘর অথবা টাকা দেওয়ার নাম করে অর্থ নেওয়া হয়েছে এ ধরনের কয়েকটি অভিযোগ তার কাছে এসেছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আলাউদ্দিন আল ওয়াদুদকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কমিটিকে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।