‘হাজার শুকরিয়া গড়ি’

বর্মি সেনাদের তাড়া খেয়ে কয়েক দিনের দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে রাখাইনের কিরণছড়ির রাশেদা বেগম ২০১৭ সালের ৩১ অগাস্ট সীমান্ত পেরিয়ে পা রাখেন কক্সবাজারের উখিয়ায়। আর বাংলাদেশে ২ সেপ্টেম্বর ছিল কোরবানির ঈদ।  

কক্সবাজার প্রতিনিধিশংকর বড়ুয়া রুমি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 August 2018, 06:28 PM
Updated : 22 August 2018, 06:41 PM

নিজের দেশে জ্বলন্ত ভিটেমাটি আর প্রিয়জনের লাশ পেছনে ফেলে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা সেই রোহিঙ্গা নারীর চিন্তায় তখন শুধু দুমুঠো অন্ন, আর মাথা গোঁজার ঠাঁই।

সেই ঈদের বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছি, সেটাই আজকে আমাদের কাছে বড় ঈদ।”

এরপর পেরিয়ে গেছে একটি বছর, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে সাত লাখ।

আশ্রয় শিবিরের অনিশ্চিয়তার মধ্যেই এই রোহিঙ্গাদের জীবনে বুধবার এসেছে আরেকটি কোরবানির ঈদ। তাদের জন্য হাজার তিনেক গরু সংগ্রহ করে জবাইয়ের পর বিতরণ করা হয়েছে মাংস।  

সেই মাংস যারা পেয়েছেন, তাদেরই একজন বালুখালী তানজিমার ঘোনা ক্যাম্পের সেলিম উদ্দিন বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তার ভাষায়।

বুধবার ঈদের বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশর সরকার হইতি জনগণ হইতি একখান চিন্তাভাবনা গইজ্জিজে কি এই রোয়াইঙ্গা অল পত্তি ঘরত কেনে গোস্ত পাইবু, গোস্ত পাইবেল্লাই বুলি ব্যবস্থা গড়ি দিয়িজে ইয়েনল্লাই হাজার হাজার শুকরিয়া গড়ি।”

তার কথার অর্থ দাঁড়ায়, বাংলাদেশ সরকার আর জনগণ সব রোহিঙ্গার ঘরে ঘরে গোস্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে; এজন্য হাজারো শুকরিয়া।

বাংলাদেশ সরকার আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চেষ্টায় এই এক বছরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় হয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা সারি সারি ঝুপড়ি ঘরের শরণার্থী ক্যাম্পে। তাদের খাবার আর চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে, এগিয়ে চলেছে প্রত্যাবাসনের আলোচনা।  

এই এক বছরে রোহিঙ্গাদের জীবন থেকে অনিশ্চয়তার মেঘ না কাটলেও বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহস তাদের বেড়েছে। নিজের ভিটায় ফিরে ঈদ করার সুযোগ আর হবে কি না- তা তারা জানেন না, কিন্তু পরবাসী জীবনে ঈদ পালনের মত স্থিতি এসেছে মনে।     

এই রোহিঙ্গা মুসলমানরা নিজেদের দেশে বেশ আয়োজন করেই ঈদের দিনটি পালন করতেন; হয়ত কোরবানি দিতেন বকরি বা গরু। বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের ঈদের আনন্দ কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নানা পদক্ষেপের কারণে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে রোহিঙ্গাদের মনে। তাদের চোখে মুখে এক বছর আগের সেই আতঙ্ক আর বিহ্বলতা আর নেই।  

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, এনজিও, সংগঠন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে দান হিসেবে তিন হাজার ২০০ গরু সংগ্রহ করেছেন তারা।

এর মধ্যে তিন হাজার গরু ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের জন্য কোরবানি দেওয়া হবে। আর ২০০ গরু দেওয়া হবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের স্থানীয় বাসিন্দাদের।

উখিয়ার ইউএনও নিকারুজ্জামান চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংগ্রহ করা গরুর মধ্যে দুই হাজার ৬৭০টি বুধবার ঈদের দিন বিতরণ ও জবাই করা হয়েছে।

“এর মধ্যে দুই হাজার ৬০০টি দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গাদের মাঝে। আর ৭০টি পেয়েছে স্থানীয়রা। বৃহস্পতি আর শুক্রবার বাকি গরুগুলোও দেওয়া হবে।”

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারটি স্থানে কোরবানির পশুগুলো জবাই করা হয়। পরে বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের সহায়তায় কোরবানির মাংস পৌঁছে দেওয়া হয় রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে। এছাড়া কিছু গরু ক্যাম্পের ব্লকভিত্তিক মাঝিদের (নেতা) মাধ্যমেও বিতরণ করা হয়।

কাম্পে থাকা সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে কত শতাংশ কোরবানির মাংস পেয়েছে, সে পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। তবে দাতাদের কাছ থেকে আরও কোরবানির পশু সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলে ইউএনও নিকারুজ্জামান জানালেন।

কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মাঝি ছুরত আলম ঈদের এই উপহারের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আাঁরা গরবার ডইল্লা (আমরা মেহমানের মতো) এদেশত আইয়েরে (এদেশে এসে) কোরবান ইয়ান গরিজ্জি ইয়ান আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। বাংলাদেশত যেগুন নাকি মুসলমান আছে বেগগুনরে হাজার হাজার দোয়া গড়া পরিবু (বাংলাদেশের যত মুসলমান আছে সবাইকে হাজার হাজার দোয়া করতে হবে)।”

কুতুপালং ডি-৫ ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বললেন, কোরবানির মাংস তিনিও পেয়েছেন; ঈদের দিনটি ‘ভালোই’ কেটেছে।

আর কুতুপালং মধুরছড়া ডি-৪ ক্যাম্পের নুরুল ইসলাম স্মরণ করলেন মিয়ানমারের অধিকারবঞ্চিত জীবনে ধর্ম পালনেও নিপীড়িত হওয়ার কথা। 

“আাঁরা হেডে বর্মার মাঝে সুন্দর গড়ি নমাজ পড়িত নপাইত্যেম। মসজিদত যাই মিলিজুলি নমাজ পড়িত নপাইত্যেম। এডে বেগগুন আল্লায় দিলি মিলিজুলি ঈদর নমাজ পড়িত পাজ্জি। খুশিকাশি লাগের বেগগুনত্তুন।”

(আমরা বার্মায় ঠিকমতো নামাজ পড়তে পারতাম না। মসজিদে গিয়ে একসঙ্গে মিলেমিশে নামজ পড়তে পারতাম না। এখানে আল্লাহর ইচ্ছায় সবাই মিলেমিশে ঈদের নামজ পড়তে পেরেছি। তাই সবাই খুশি।)