২১ অগাস্ট: বিচারের অপেক্ষায় স্বজনরা

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের চানপট্টি গ্রামের নুসরাত জাহান মিথিলার প্রথম জন্মদিন ছিল ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর। কথা ছিল, বাবা ঢাকা থেকে ফিরবেন নতুন জামা নিয়ে। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি।

রিপনচন্দ্র মল্লিক মাদারীপুর প্রতিধি এবং আল-ইমরান শোভন, চাঁদপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2018, 08:48 AM
Updated : 21 August 2018, 08:48 AM

ওই বছর ২১ অগাস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আরও অনেকের সঙ্গে নিহত হন মিথিলার বাবা যুবলীগ নেতা লিটন মুন্সি।

এ বছর ১ সেপ্টেম্বর মিথিলার ১৪ বছর পূর্ণ হবে। আসছে বছর ডনোভান সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে উঠবে সে। তার নতুন জামার অপেক্ষা এখন পরিণত হয়েছে পিতৃহত্যার বিচারের অপেক্ষায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মিথিলা বলে, “তখন আমার বোঝার বয়স ছিল না। আস্তে আস্তে সব বুঝতে পেরেছি। মায়ের কাছে সব শুনেছি। এত বছর পার হল, আমার বাবাসহ এতগুলো মানুষের হত্যার কোনো বিচার হয়নি। সরকারের কাছে আমার একটাই দাবি, ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের সঠিক বিচার যেন নিশ্চিত হয়।”

শুধু মিথিলার পরিবার নয়, বর্বর ওই হামলায় নিহত মাদারীপুরের চার পরিবার আর চাঁদপুরের দুই পরিবারের এখন একটাই দাবি- স্বজন হত্যার বিচার।

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার কর্মসূচি ছিল। শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরপরই তা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু গ্রেনেড হামলায় স্তব্ধ হয়ে যায় সেই কর্মসূচি।

হামলায় প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন, আহত হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ। সেদিন বেঁচে গেলেও স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এই হামলা হয়েছিল এবং তাতে প্রত্যক্ষ মদদ ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ নেতাদের।

ওই হামলার নিহতদের মধ্যে চারজন ছিলেন মাদারীপুরের, দুজনের বাড়ি চাঁদপুরে।

লিটন মুন্সি ছাড়া মাদারীপুরের বাকি তিনজন হলেন- কালকিনি উপজেলার কয়ারিয়া ইউনিয়নের রামপোল গ্রামের শ্রমিক লীগ নেতা নাসির উদ্দিন, একই উপজেলার ক্রোকিরচর গ্রামের যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ (কালা সেন্টু) এবং রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি ইউনিয়নের মহিষমারি গ্রামের সুফিয়া বেগম।

ওই হামলায় নিহত চাঁদপুরের দুজন হলেন মতলব উত্তরের পাঁচআনী গ্রামের আতিক উল্ল্যাহ এবং হাইমচর উপজেলার আবদুল কুদ্দুছ।

এসব পরিবারে শোক আর স্বজন হারানোর বেদনা এখনও কাটেনি। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাদের দিন কাটছে দৈন্যদশায়; আহতদের বেশিরভাগ কর্মক্ষমতা হারিয়ে হয়ে পড়েছেন পরিবারের বোঝা।

যুবলীগ নেতা লিটন ঢাকা যাওয়ার সময় তার মা আছিয়া খাতুনকে বলে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে পেটের পাথর অপারেশনের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু নয় দিনের মাথায় তিনি নিজেই লাশ হয়ে গ্রামে ফেরেন।

লিটনের বাবা আইয়ুব আলী মুন্সি বলেন, “একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে একেবারে শেষ হয়ে গেছি। এখন আমাদের চোখের জল ছাড়া আর কিছুই নেই। সরকারের কাছে আমাদের ছেলে হত্যার বিচার চাই।”

লিটনের মেয়ে মিথিলার জন্য প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। এছাড়া গত রোজায় সরকারিভাবে দেওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ টাকার অনুদান। তাই সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন লিটনের স্ত্রী মাফিয়া আক্তার।

হামলাস্থলে পড়ে আছে অবিস্ফোরিত গ্রেনেড

২১ অগাস্টের হামলায় নিহত শ্রমিক লীগ নেতা নাসির উদ্দিনের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে হলেও তিনি থাকতেন ঢাকার হাজারিবাগে। এক সময় হাজারীবাগ শ্রমিক লীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি।

স্বজনরা জানান, নাসির ঢাকায় কখনও রিকশা চালাতেন, কখনও অন্য একজনের দোকানে কাজ করতেন। আওয়ামী লীগের সব মিছিল, সমাবেশে উপস্থিত হতেন; মিছিলের সামনে থেকে শ্লোগান দিতেন।

রাজনীতির জন্য জীবন উৎসর্গ করা সেই নাসিরউদ্দিনের বৃদ্ধ মা-বাবা আর স্ত্রী-সন্তানদের খবর এখন কেউ রাখে না।

নিহত আরেক যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহম্মেদ সেন্টুর স্ত্রী আইরিন পারভীন বলেন, “ওকে হারিয়ে আমরা পথে বসে গেছি। খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমভাবে বেঁচে আছি।”

মাদারীপুরের নিহতদের মধ্য চতুর্থজন সুফিয়া বেগম ওইদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে মহিলা নেত্রীদের সঙ্গে প্রথম সারিতেই ছিলেন। উদ্যমী সুফিয়া সপরিবারে ঢাকায় থাকতেন।

ওইদিনের গ্রেনেড হামলায় একটি পা হারিয়েছেন কালকিনি পৌরসভার বিভাগদী গ্রামের মোহাম্মাদ আলী হাওলাদারের ছেলে হালান হাওলাদার। আজীবন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তাকে।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হালান হাওলাদার বলেন, “অনেক শখ করে সেদিন আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনতে যাই। হাজারো মানুষ ঠেলে ঠেলে মঞ্চের খুব কাছাকাছি আসতেই বোমার বিকট শব্দ হয়। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে দেখি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।”

কালকিনির ঝাউতলা গ্রামের ওয়াহেদ সরদারের ছেলে সাইদুল হক সরদারও শরীরে স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাময় জীবনযাপন করছেন। ইদানিং চোখেও তিনি ঝাপসা দেখেন।

দেশে ভালো কিছু করতে না পেরে কয়েক বছর আগে জমি বিক্রি করে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন সাইদুল। কিন্তু স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে সেখানেও কিছু করতে না পেরে ফিরে আসেন।

২১ অগাস্টের ঘটনা স্মরণ করে সাইদুল বলেন, “আমি ছিলাম অনেক পিছনে। শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য আস্তে আস্তে মঞ্চের ১০ থেকে ১২ হাত দূরত্বে চলে আসি। বক্তব্য প্রায় শেষ…  তার মধ্যে বোমা ফাটার মত শব্দ। চারদিকে ধোঁয়া আর মানুষজনের চিৎকার।

“আমি কোনো কিছু না বুঝে দৌড় দিতে যাব, তখন তৃতীয় গ্রেনেডটা ফাটলো। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম বহু মানুষ আমার শরীরের উপর দিয়েই যাচ্ছে। তারপর চেতনা হারিয়ে ফেলি, ভাবিনি বেঁচে যাব।”

এখন যে যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, তার চেয়ে মৃত্যুও হয়ত ভালো ছিল বলে কখনও কখনও মনে হয় সাইদুলের।

ওই গ্রেনেড হামলায় ডান হাত বাঁকা হয়ে গেছে কালকিনির কৃষ্ণনগর গ্রামের কবির হোসেনের। ঢাকার এক বস্তিতে থেকে এখন দিনমজুরের কাজ করেন তিনি।

সে দিনের নরকীয় পরিস্থিতির কথা মনে পড়লে আজও শিউরে ওঠেন আহতরা। নিহতদের স্বজনরা এখনও চোখ মোছেন।

ওই হামলায় নিহত চাঁদপুরের মতলব উত্তরের আতিক উল্ল্যাহর পরিবার পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে দুই দফায় ৩৬ লাখ এবং হাইমচর উপজেলার আবদুল কুদ্দুছের পরিবার দুই দফায় ২৭ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৪ বছরেও বিচার না পাওয়ায় তাদের হৃদয়ের ক্ষত শুকায়নি।

হাইমচরের আব্দুল কুদ্দুছ ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। তার বড় ভাই হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী বলেন, “শুধু আমার ভাই নয়, শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে ২৪ জন ওইদিন মারা যান। চাঁদপুরের নিহত দুই জনের স্মৃতি ধরে রাখতে তাদের নামে এখানে একটি মেডিকেল কলেজ করার দাবি জানাই আমরা।”

মতলব উত্তর উপজেলার পাঁচআনী গ্রামের আতিক উল্লাহর স্ত্রী লাইলী বেগম বলেন, “আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার পরিবারকে যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তাতে আমি উনার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার স্বামীকে যারা হত্যা করল, তাদের বিচার না হওয়ায় আমি চিন্তিত।”

মতলব উত্তরের উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনজুর আহমদ বলেন, “শুধু কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়েই ওইসব পরিবারের শোক মুছে ফেলা যাবে না। অপরাধীরা শাস্তি পেলে কিছুটা হলেও তারা শান্তি পাবে।”