হলি আর্টিজান: ৩ সন্তান নিয়ে সংগ্রামে সাইফুলের স্ত্রী

দুই বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে নিহত পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের স্ত্রী সংসার চালান সেলাই কাজ করে।

কে এম রায়হান কবীর শরীয়তপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2018, 05:34 PM
Updated : 29 June 2018, 05:40 PM

এছাড়া তাদের সন্তানের লেখাপড়ার জন্য হলি আর্টিজান কর্তৃপক্ষ প্রতিমাসে কিছু টাকা দেন বলে স্বজনরা জানিয়েছেন।

সাইফুল নিহত হওয়ার তিন মাস পর জন্ম হয় ছেলে হাসানের। তার বয়স এখন ২১ মাস। হাসান এখন বাবা বলতে শিখেছে। সাইফুলের তিন সন্তানের মধ্যে বড় দুজন মেয়ে। এদের মধ্যে সামিয়া (১১) ৫ম শ্রেণিতে এবং ইমলী (৯) তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে স্থানীয় একটি স্কুলে।

হামলাকারীদের সঙ্গে লাশ মেলায় সাইফুলের গায়েও লেগে গিয়েছিল ‘জঙ্গি তকমা’। পরে স্বজনরা তাকে বেকারির পাচক হিসেবে সনাক্ত করলেও লাশ আর ফেরত পায়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও মেলেনি কোনো সহায়তা।

তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া আকতারের এখন দিন কাটে খেয়ে-না খেয়ে। সন্তানদের ভবিষ্যত চিন্তাতেই অস্থির থাকতে হয় তাকে।

সাইফুল ইসলাম চৌকিদার

২০১৬ সালের ১ জুলাই কয়েকজন যুবক অস্ত্রহাতে হলি আর্টজানে ঢুকে ভেতরে থাকা লোকজনকে জিম্মি করে। পরদিন কমান্ডো অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনী হলি আর্টিজানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর জিম্মি ২০ জনের মৃতদেহের পাশাপাশি আরও কয়েকজনের লাশ উদ্ধার করে।

হামলাকারী হিসেবে পাঁচজনের লাশের ছবি সাংবাদিকদের পাঠায় পুলিশ। তার আগেই জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের বরাতে পাঁচ হামলাকারীর ছবি আসে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের মাধ্যমে।

পুলিশের দেওয়া ছবিগুলোর মধ্যে চারটির সঙ্গে আইএসের দেওয়া চারজনের ছবির মিল পাওয়া গেলেও মিলছিল না শেফের পোশাক পরা একজনের চেহারায়।

পরে সাদা অ্যাপ্রন পরা ওই ব্যক্তিকে হলি আর্টিজান বেকারির ‘শেফ’ সাইফুল ইসলাম চৌকিদার বলে শনাক্ত করেন তার স্বজনরা।

অনেক চেষ্টা করেও সাইফুলের স্বজনরা তার লাশ পায়নি। জঙ্গিদের সঙ্গে তার লাশ ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

সাইফুলে কথা জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার স্ত্রী সোনিয়া আকতার।

সাইফুলের ছেলে হাসানের বয়স এখন ২১ মাস

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পৌর মেয়র সাটিফিকেট দিলেও সাইফুলের মরদেহটাও আমাদেরকে দেওয়া হয়নি। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে বেওয়ারিশ লাশ বলে নিহত জঙ্গিদের সঙ্গে দাফন করা হয়েছে। আমার অবুঝ শিশুটি বড় হয়ে তার বাবার কবরটাও দেখতে পাবে না। এর চাইতে আর দুঃখ কী হতে পারে।”

সাইফুল নিহত হওয়ার পর থেকেই তার মা অসুস্থ বলে জানান সোনিয়া।

সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য করা হয়নি উল্লেখ করে সোনিয়া বলেন, “হলি আর্টিজান কর্তৃপক্ষ ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার জন্য মাসিক কিছু টাকা দেয়। বাকি খরচ চালাতে হয় সেলাই মেশিনে কাজ করে এবং পরের উপর নির্ভর করে। আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে কোনোরকম বেঁচে আছি।”

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কলুকাঠি গ্রামের মৃত আবুল হাসেম চৌকিদারের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সাইফুল। তার ছোট ভাই বিল্লাল মালয়েশিয়ায় থাকেন। তিন বোনের সবার বিয়ে হয়েছে, থাকেন স্বামীর বাড়িতে।

১০ বছর জার্মানিতে থাকার পরে দেশে ফিরে নিহত হওয়ার দেড় বছর আগে হলি আর্টিজানে পিৎজা তৈরির শেফ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সাইফুল।

নিহত হওয়ার পর থেকে পুলিশ সাইফুলকে জঙ্গি হিসেবে প্রচার করে। হামলার খবর টেলিভিশনে প্রচার হতে দেখে পরিবারের লোকজন ওই রাতে সাইফুলকে ফোন করে না পেয়েই শুরু করে আহাজারি। পরে স্বজনরা ঢাকায় গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন।

তদন্তকালে সাইফুলের মা সমেরা বেগমকে ছেলের লাশ শনাক্তের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য ও নড়িয়া থানা থেকে সাইফুলের নামে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তিন মাস তদন্ত শেষে বেওয়ারিশ হিসেবে সাইফুলের লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে হস্তান্তর করে। নিহত জঙ্গিদের সঙ্গেই জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

দুবছর আগের এ হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলার অভিযোগপত্র আগামী দশ দিনের মধ্যে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।

বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই মামলাটির তদন্ত করতে গিয়ে কাউন্টার টেরিজম ইউনিট অনেক তথ্য পেয়েছে। এটা ছিল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তদন্ত একেবারে শেষ পর্যায়ে । সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।”