‘বন্দুকযুদ্ধে’ কাউন্সিলর একরাম নিহতের তদন্ত চান আ. লীগ নেতারা

মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে কথিত যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হয়েছেন, তার তদন্ত চেয়েছেন পরিবারের সদস্য ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

কক্সবাজার প্রতিনিধিশংকর বড়ুয়া রুমিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2018, 06:59 PM
Updated : 29 May 2018, 11:37 AM

তারা বলছেন, র‌্যাব ভুল তথ্য পাওয়ায় এমন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা তদন্ত হওয়া দরকার। 

গত শনিবার রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নোয়াখালিয়া পাড়ায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ৪৬ বছর বয়সী একরামুল হক।

তিনি টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়ার মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে এবং একই স্থানীয় ওয়ার্ডের পর পর তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর।

একরামুল টেকনাফ বাস স্টেশন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ছিলেন। দীর্ঘ দিন তিনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একসময় তিনি টেকনাফ হাইএস মাইক্রো শ্রমিক ইউনিয়নের আহবায়কও ছিলেন।

একরামুল নিহত হওয়ার পর র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তার বাবার নাম আবদুস সাত্তারের জায়গায় লেখা হয় মোজাহার মিয়া ওরফে আবদুস সাত্তার। আর ঠিকানার জায়গায় টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়ার বদলে লেখা হয় নাজিরপাড়ায়।

ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’ এবং ‘ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার’ আখ্যায়িত করে বলা হয়, একরামের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মাদক আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।

একরামুলের ভাই এহসানুল হক বাহাদুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে সাধারণ পোশাকের কিছু লোক শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার ভাইকে ডেকে নিয়ে যায়। তারা জানায়, জমি বিক্রির ব্যাপারে একরামুলের সঙ্গে কথা বলতে চায় তারা।

পরে গভীর রাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একরামুলের নিহত হওয়ার খবর পান বলে জানান এহসানুল।

র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাবার নামে অসঙ্গতির বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের বাবার অন্য কোনো নাম নেই। আর টেকনাফ পৌরসভায় নাজিরপাড়া নামে কোনো এলাকাও নেই। নাজির পাড়া এলাকাটি টেকনাফ সদর ইউনিয়নে।

এহসানুল বলেন, “টেকনাফ সদরের নাজিরপাড়ার বাসিন্দা মোজাহার মিয়ার কয়েকজন ছেলে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও তথ্য রয়েছে।”

র‌্যাব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে একরামুলকে ধরে নিয়ে ওই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন তার ভাই।

একরামের স্ত্রী আয়েশা খাতুনও দাবি করেন, তার স্বামী কোনো সময়ই ইয়াবার কারবারে জড়িত ছিলেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি রণজিত কুমার বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকমকে বলেন, পৌর কাউন্সিলর একরামুলের বিরুদ্ধে এক সময় টেকনাফ থানায় দুটি মামলা ছিল। এর মধ্যে একটি মারামারির ঘটনায় এবং অন্যটি মাদক আইনে।

“মারামারির ঘটনার মামলাটি ইতোমধ্যে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। আর মাদকের মামলাটিতে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।”

তবে পরিবারের সন্দেহ, বাবার নাম ও ঠিকানায় অসঙ্গতি এবং মামলার তথ্য নিয়ে কক্সবাজার র‌্যাবের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।

কথিত বন্দুকযুদ্ধে একরামুলের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্থানীয়রাও ফেইসবুকে সরব হয়েছেন। 

এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী মাবু ফেইসবুকে প্রধানন্ত্রী বরাবর একটি খোলা চিঠি লিখে একরামুল নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, একরামুল হক ছাত্রজীবন থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক দশকের বেশি সময় উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

“তার মৃত্যুর ঘটনাটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তো বটেই, টেকনাফের সাধারণ মানুষও সহজভাবে নিচ্ছে না। এটার কোথাও ভুল রয়েছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্পষ্ট করতে হবে।”

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল বশর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অর্থনৈতিকভাবে তেমন স্বচ্ছল ছিলেন না বলে একরামুল নিজের বাড়ি নির্মাণের কাজ দুই দশকেও শেষ করতে পারেননি।

“প্রতিমাসে নিজের সন্তানের স্কুলের বেতন দিতেও হিমশিম খেতে হত তাকে। তাই একরামুলকে ইয়াবা ব্যবসায়ী বলাটাও হাস্যকর।”

নুরুল বশর অভিযোগ করেন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা যে তালিকা ধরে অভিযান চালাচ্ছে, সেখানে ‘চিহ্নিত অনেক মাদক চোরাকারবারির’ নাম আসেনি। আবার ‘নিরাপরাধ-নির্দোষ’ অনেককেও তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

“এর মধ্যে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনায় মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে।”

সুনির্দিষ্ট ‘অভিযোগ না থাকার পরও’ কথিত বন্দুকযুদ্ধে একরামুলের নিহত হওয়ার ঘটনাটি তালিকাভুক্ত শীর্ষ চোরাকারবারিদের ষড়যন্ত্র কি না- তা খতিয়ে দেখতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল বশর।

‘মাদক কারবারি ও গডফাদারদের’ তালিকায় পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের নাম ছিল কিনা জানতে চাইলে সরাসরি কোনো উত্তর দেননি কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থার তৈরি চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেই পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন-শৃংখলা বাহিনী অভিযানে নেমেছে।… তালিকাভুক্তদের সঠিক ও প্রকৃত তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পরই অভিযান চালানো হচ্ছে।”

ভুল তথ্যের কারণে কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বলেও দাবি করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।

মাদকবিরোধী অভিযানে গত ১৮ মে থেকে এ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় চারজন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে দুইজন পুলিশ ও রাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে এবং দুইজন মাদক কারবারিদের নিজেদের দ্বন্দ্বে গুলিতে নিহেত হয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য।