পাহাড়ে সংঘাতে ৫ মাসে ঝরেছে ১৮ প্রাণ

দুই দশক আগের শান্তিচুক্তি পাহাড়ে রক্তক্ষয় অবসানের প্রত্যাশা জাগালেও এরপর থেকে চলছে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর নিজেদের কোন্দল, যার পরিণতিতে গত পাঁচ মাসে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন। 

ফজলে এলাহী রাঙামাটি প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 May 2018, 04:21 AM
Updated : 5 May 2018, 04:33 AM

এক সময়ের একক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে এখন অন্তত চারটি দল সক্রিয় পাহাড়ে; তাদের কোন্দলের সর্বশেষ নজির গত দুই দিনে ছয়জনের মৃত্যু।

এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাঙামাটির পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র তৎপরতা এবং এমন বেপরোয়া হত্যার ঘটনাকে সরকার গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। এখন সরকার যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই আমরা পদক্ষেপ নেব।”

১৯৯৭ সালে সরকার এবং জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন জেএসএসের মধ্যে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর তার বিরোধিতায় গড়ে ওঠে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।

সেই থেকে দুই দলের বিরোধে ২০১৬ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে মারা গেছে প্রায় এক হাজার নেতা-কর্মী। ২০১৬ সালে দুই দলের মধ্যে অলিখিত ও অপ্রকাশ্য এক সমঝোতায় সশস্ত্র সংঘাত থামলে কিছুটা স্বস্তি আসে পাহাড়িদের মনে।

কিন্তু এরই মধ্যে জেএসএস থেকে বেরিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) এবং ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দল গড়ে ওঠে, যা সংঘাতে আনে নতুন মাত্রা।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পূর্তিতে এক আলোচনা সভায় জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা পাহাড়ে আবার আগুন জ্বালাবে।

তার ঘোষণার দুদিন পরেই ৫ ডিসেম্বর অনাধি রঞ্জন চাকমা (৫৫) নামে ইউপিডিএফ সমর্থক ইউপি সদস্যকে হত্যা করা হয়। এই হত্যার জন্য ইউপিডিএফকে (গণতান্ত্রিক) দায়ী করে ইউপিডিএফ।

ওই দিন সকালে অনাধিকে নানিয়ারচর সতেরোমাইল ও আঠারোমাইলের মধ্যবর্তী চিরঞ্জীব দোজরপাড়া এলাকার নিজ বাসা থেকে ডেকে বের করে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।

পাহাড়িদের পুরনো সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সন্তু লারমা

একই দিন রাঙামাটির জুরাছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দ চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসকে দায়ী করে। একই দিন বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাসেল মার্মাকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়।

একদিন বাদেই ৭ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভানেত্রী ঝর্ণা খীসার বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে কুপিয়ে জখম করা হয়।

১৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি সদর উপজেলার বন্দুকভাঙ্গায় ইউপিডিএফকর্মী ও সংগঠক অনল বিকাশ চাকমাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। ইউপিডিএফ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য নতুন ইউপিডিএফকে দায়ী করে।

প্রসিত বিকাশ খীসা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউপিডিএফকে

৩ জানুয়ারি বিলাইছড়ি উপজেলায় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বরায় তংচঙ্গ্যাকে গুলি করা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনার জন্য যুবলীগ জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছিল।

৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মিঠুন চাকমাকে। ইউপিডিএফ এই হত্যার জন্য ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিককে দায়ী করে।

৩০ জানুয়ারি বিলাইছড়িতে আওয়ামী লীগের তিন কর্মীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়। এই ঘটনার জন্য সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করে আওয়ামী লীগ। ১২ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি শহরে ছাত্রলীগ নেতা সুপায়ন চাকমাকে মারধর করে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কর্মীরা, প্রতিবাদে রাঙামাটিতে হরতাল পালন করে ছাত্রলীগ।

২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামের একজন গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তিনিও ইউপিডিএফ কর্মী ছিলেন।

১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় ইউপিডিএফ কর্মী দীলিপ কুমার চাকমাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি ইউপিডিএফের হরিনাথ পাড়ার সাংগঠনিক দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পানছড়ির চেঙ্গী ইউনিয়নের মনিপুর এলাকার সন্তোষ কুমার চাকমার ছেলে।

জেএসএসের (এমএন লারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন শক্তিমান চাকমা

১১ মার্চ বাঘাইছড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফকর্মী নতুন মনি চাকমাকে। তিনি ইউপিডিএফের প্রসীত বিকাশ খীসার পক্ষের ছিলেন।

১৮ মার্চ রাঙামাটির কুতুছড়ি থেকে অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে। ৩২ দিন পর ১৯ এপ্রিল মুক্তি পান তারা। এই ঘটনার জন্য ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিককে দায়ী করে ইউপিডিএফ।

১২ এপ্রিল পাল্টাপাল্টি হামলায় মারা যান তিনজন।  রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় ইউপিডিএফের এক সদস্যকে গুলিতে হত্যার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জেএসএসের (এমএন লারমা) দুই কর্মীকে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন ইউপিডিএফ কর্মী জনি তঞ্চঙ্গ্যা (৪০), জেএসএস (এমএন লারমা) কর্মী পঞ্চায়ন চাকমা ওরফে সাধন চাকমা (৩০) ও কালোময় চাকমা (২৯)।

১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি শহরের পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নামে একজন নিহত হন। তিনিও ইউপিডিএফ এর দুই অংশের বিরোধের কারণে মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়।

তপনজ্যোতি চাকমা বর্মা ছিলেন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের নেতা

২২ এপ্রিল খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার মরাটিলা এলাকায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসের (এমএন লারমা) মধ্যে গোলাগুলিতে সুনীল বিকাশ ত্রিপুরা (৪০) নামে এক ইউপিডিএফ নেতা নিহত হন।

সর্বশেষ ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলায় নিজ কার্যালয়ে সামনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএসের (এমএন লারমা) অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে। এইসময় তার সাথে থাকা সংগঠনটির আরেক নেতা রূপম চাকমাও গুলিবিদ্ধ হন।

এর একদিন পরেই ৪ মে শক্তিমান চাকমার দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে যাওয়ার পথে সশস্ত্র হামলায় নিহত হন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের অন্যতম শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মা, একই দলের নেতা সুজন চাকমা, সেতুলাল চাকমা, টনক চাকমা এবং তাদের গাড়িচালক সজীব।