বৈসাবি সুর পাহাড়ে পাহাড়ে

কলাপাতার ভেলায় চেপে জলে ভেসে যাচ্ছে বিজু, মধু মালতী, জবা আর নয়নতারা; সঙ্গে যাচ্ছে পুরনো বছর।

ফজলে এলাহী রাঙামাটি ও চবাথুই মারমা, বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2018, 07:20 AM
Updated : 12 April 2018, 09:30 AM

এই বিদায়ে বিচ্ছেদের বেদনা নেই, আছে নতুন প্রাণের আশ্বাস, পাহাড়ে নতুন ভোরের আনন্দ।

বর্ণিল আয়োজনে পাহাড়ে শুরু হয়েছে বর্ষবরণ ও বিদায়ের উৎসব বৈসাবি। বৃহস্পতিবার সকালে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে চাকমা জনগোষ্ঠীর মানুষ পালন করেছে এ উৎসবের প্রথম দিনের ‘ফুলবিজু’। আর ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ একই রীতিতে পালন করেছে ‘হারি বৈসুক’।

সকাল ৭টায় রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ী ঘাটে চাকমাদের ফুলবিজুতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্যাঞ্চল কমিটির সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা।

বিপুল সংখ্যক চাকমা তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ অংশ নেয় এই আয়োজনে।

সকাল ৮টায় রাঙামাটি শহরের গর্জনতলি এলাকায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা অংশ নেন ‘হারি বৈসুক’-এ। তারাও একইভাবে পানিতে ফুল ভাসিয়ে, ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নাচ নেচে, বয়স্কদের বস্ত্র দান করে এ উৎসব শুরু করেছে।

শুক্রবার চাকমাদের ‘মূল বিজু’, ত্রিপুরাদের ‘বুইসুকমা’ পালিত হবে। আগামী ১৮ এপ্রিল মারমা জনগোষ্ঠীর ‘সাংগ্রাই’ এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের বৈসাবি। 

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বাসিন্দারা ভিন্ন ভিন্ন নামে বর্ষবরণ উৎসব পালন করলেও উদযাপনের ধরন আর রীতি প্রায় একই রকম। ১৯৮৫ সাল থেকে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান আর রাঙামাটির বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে ‘বৈসাবি’ নামে এ উৎসব উদযাপন করে আসছে।

বৈসাবি শব্দটি এসেছে ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসবের নাম মিলিয়ে। এ উৎসব এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের ঐক্য আর বন্ধনের প্রতীক।

বৈসুক:

ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে প্রধানতম উৎসব বুইসুক, বৈসুক বা বৈসু। চৈত্র মাসের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের দিন পালন করা হয় এই উৎসব। চৈত্রমাসের শেষ দুইদিনের প্রথম দিনকে ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে। আর নববর্ষের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘বিসিকাতাল’।

উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তুলে ঘর সাজায়। ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয় তারা। এ দিন গৃহপালিত সব প্রাণিকে খুব ভোরে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে ছেলেমেয়েরা গ্রামে ঘুরে বেড়ায়; খবারের আয়োজনে থাকে হরেক পিঠা।  

বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরাইয়া’ নামে একটি নাচের দল গ্রামের বড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখায়। ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা এই এই নাচের দলের শিল্পীদের একজনের কাঁধে একটি শূল থাকে, যাতে বাঁধা থাকে একটি খাদি। যদি কোন ঘরের উঠোনে এই শূলটি বসানো হয় তবে ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়।

প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে নাচ শেষে গৃহস্থরা শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চালসহ অন্যান্য জিনিস দান করেন। বিনিময়ে শিল্পীরা সেই গৃহস্থকে সুর করে আশীর্বাদ করে। শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে। কোন শিল্পী যদি একবার এই গড়াইয়া নাচে অংশ নেয় তবে তাকে তিনবছর পর পর এই নৃত্যে অংশ নিতে হয়। নতুবা তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যু হয় বলে ‘ত্রিপুরা মিথ’ আছে।

এই লোকনৃত্যটিতে ১৬ জন থেকে ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারে। বৈসুক উৎসবের জনপ্রিয় এ নাচ দেখতে সারাদেশ থেকে শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে যান।

বিজু:

চাকমারা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুলবিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূলবিজু’ এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ‘গজ্যাপজ্যা’ বিজু পালন করা হয়।

ফুলবিজুর দিন চাকমারা বিজুর ফুল তুলে তা দিয়ে ঘর সাজায়।পরে সে ফুল নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিজুর সময় ছোট ছেলেমেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে দলবেঁধে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বড়দের সালাম করে এবং ঘরের হাঁস মুরগিকে ধান চাল ছিটিয়ে দিয়ে খাওয়ায়।

এ সময় হরেক রকম সবজি আর তরকারি দিয়ে ‘পাঁজন’ নামের একটি খাবার তৈরি করা হয়। এছাড়া পায়েস ও নানা ধরনের পিঠা এবং মাছ-মাংসও রান্না করা হয়। থাকে বিন্নি ধানের খই, নাড়ু, সেমাই ও পাহাড়ি মদ।

এদিন চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে র‌্যালিতে যোগ দেয়, শিশুরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং শিশু কিশোর ও তরুণ তরুণীরা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। সন্ধ্যায় বাড়ির উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা এবং মন্দিরে গিয়ে মোম জ্বালিয়ে পূজা করা হয়।

বিজু উৎসবের সময় মাছ- মাংসের আয়োজন না থাকলেও নববর্ষের দিন মজার সব খাবারের আয়োজন করা হয। নতুন বছরে ভালো কিছু খেলে সারা বছর ধরে ভালো খাবার খেতে পারবে বলে চাকমারা বিশ্বাস করে।

সাংগ্রাই

পুরানো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে সাংগ্রাই উৎসব বলে। মারমারা সাধারণত চন্দ্রমাস অনুসারে এই দিনটি পালন করে। বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিনে এ উৎসব হয়। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে এ উৎসব পালন করা হয় বলে ‘সংক্রান্তি’ শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দ এসেছে।

এদিন পাঁচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা জনগোষ্ঠী। সবাই নতুন পোশাক পরে, একে অপরের বাড়ি যায় এবং কুশল বিনিময় করে। সববয়সী নারীপুরুষ নেচে গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে; বৃদ্ধরা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যায়। এছাড়া মারমারা ‘ঘিলাখেলা’ নামে একটি খেলা খেলে।

এ উৎসবের  প্রধান আকর্ষণ জলঅনুষ্ঠান বা ‘পানিখেলা’। বাড়ির আঙিনায় আগে থেকে পানি খেলার জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা থাকে। মারমা যুবকরা বাদ্য আর গানের তালে তালে এসে উপস্থিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে।

সেখানে ফুলে ফুলে সাজানো প্যান্ডেলের ভেতর পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে মারমা তরুণীরা। পরে তারা এক অপরকে জল ছিটায়। পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে মারমা তরুণ তরুণীরা পানি ছিটিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়।

মারমা সংস্কৃতি সংসদ প্রতি বছর মারমা অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে এই পানি উৎসব করে। এ বছর এই পানি খেলা ১৮ এপ্রিল রাঙামাটির আসামি বস্তির নারকেল বাগানে অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়া বান্দরবানে চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বিজু উৎসব শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে সাঙ্গু নদীতে ফুল ভাসিয়ে নতুন স্বাগত জানায় তারা।