রথীশচন্দ্র স্ত্রীর ‘পরকীয়ার বলি’

রংপুরের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা তার স্ত্রী স্নিগ্ধা সরকার দীপার পরকীয়া প্রেমের জেরে খুন হয়েছেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব। 

রংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2018, 09:17 AM
Updated : 4 April 2018, 11:23 AM

এ ঘটনায় রংপুরের তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দীপা ও তার সহকর্মী কামরুল ইসলামসহ মোট চারজনকে আটক করা হয়েছে। 

দীপার বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, রথীশকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয় দুই মাস ধরে। সে অনুযায়ী, গত ২৯ মার্চ রাতে খাবারের সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে গলায় ওড়না পেচিয়ে শ্বাসরোধে তাকে হত্যা করা হয়।

পরে আলমারিতে ভরে আধা কিলোমিটার দূরে তাজহাট মোল্লাপাড়া এলাকায় কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বালির নিচে পুঁতে ফেলা হয় রথীশের লাশ।

দীপাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার মধ্যরাতে ওই নির্মাণাধীন ভবন থেকে রথীশের লাশ উদ্ধার করে র‌্যাব।

রথীশের ভাই সাংবাদিক সুশান্ত ভৌমিক সুবল রাতেই লাশটি তার ভাইয়ের বলে শনাক্ত করেন। রথীশের স্ত্রী দীপাকেও র‌্যাব সেখানে নিয়ে গিয়েছিল।

বুধবার দুপুরে রংপুরের র‌্যাব-১৩ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বাহিনীর মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ৩০ মার্চ সকাল থেকে রথীশচন্দ্রের নিখোঁজ থাকার বিষয়টি ছিল ‘তার স্ত্রীর সাজানো নাটক’। হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে ওই কৌশলে সবার নজর তিনি ভিন্ন দিকে সরানোর চেষ্টা করেছেন।

“আসলে ২৯ মার্চ রাতেই নিজের শোবার ঘরে খুন হন রথীশ। তার স্ত্রী দীপা ভৌমিকের সঙ্গে তার স্কুলের সহকর্মী কামরুল ইসলামে পরকীয়া প্রেম চলছিল। এ নিয়ে রথীশের সঙ্গে দীপার কলহ লেগেই থাকত।”

রথীশচন্দ্র ভৌমিক ও স্নিগ্ধা সরকার দীপা

কামরুল ইসলাম

রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক রথীশ জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি এবং মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন।

হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি, জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।

দীপা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ৩০ মার্চ ভোরে নগরীর বাবুপাড়া এলাকার বাড়ি থেকে বের হয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে শহরের দিকে রওনা হয়েছিলেন রথীশ। এরপর থেকে তার সন্ধান তারা পাচ্ছেন না।

অন্তর্ধানের পর ট্রাস্টের নেতারা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াতে ইসলামী কিংবা জঙ্গি গোষ্ঠী কিংবা ভূমিদস্যুরা রথীশকে ধরে নিয়ে গেছে।

রথীশের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সোমবার সন্দেহভাজন নয়জনকে আটক করে পুলিশ। এরপর মঙ্গলবার দুপুরে রথীশের বাড়ির পাশে আট-দশ ফুট গভীর একটি ডোবায় শুরু হয় তল্লাশি।

সেখানে বিকালে আবর্জনার নিচে হালকা রক্তের ছিটা লাগানো সাদা একটি শার্ট পাওয়ার পর তা মাহিগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে নেওয়া হয়। রথীশের ছোট ভাই সুশান্ত তা দেখে বলেন, শার্টটিতে রক্তের ছিটার মত কিছু লেগেছিল, তবে সেটি তার ভাইয়ের জামা নয়। 

রাতে ডোবায় তল্লাশি অভিযান পুলিশ স্থগিত রাখার খানিক পর তাজহাটে র‌্যাবের অভিযানে কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন বাড়িতে রথীশের লাশ পাওয়ার খবর আসে।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ছায়া তদন্তে নেমে সোমবার তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলামসহ দুজনকে তারা আটক করেন। এরপর তদন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

কামরুলের বক্তব্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে দীপাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার স্বীকারোক্তি থেকেই পরে লাশ উদ্ধার করা হয় বলে র‌্যাব মহাপরিচালকের ভাষ্য।

নির্মাণাধীন এই বাড়িতে পাওয়া গেছে রথীশচন্দ্রের লাশ

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদ

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “পারিবারিক কলহ, সন্দেহ আর পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হয়ে দীপা তার স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং এ কাজে তাকে সহায়তা করে তার কথিত প্রেমিক কামরুল মাস্টার। … নিহতের স্ত্রীর স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, গত দুই মাস ধরে তারা এই হত্যার পরিকল্পনা করে।”

সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯ মার্চ রাত ১০টার দিকে ভাত ও দুধের সঙ্গে ১০টি ঘুমের বড়ি খাওয়ানো হয় রথীশকে। কামরুল আগে থেকেই সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। রথীশ অচেতন হয়ে গেলে গলায় ওড়না পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর রাতে রথীশের লাশ রেখে দেওয়া হয় তারই শোবার ঘরে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের পরদিন ভোরে কামরুল ওই বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটি ভ্যান নিয়ে আসেন। একটি আলমারি পরিবর্তনের নাম করে সেই আলমারিতে লাশ ভরে নিয়ে যাওয়া হয় তাজহাটের মোল্লাপাড়ায় কামরুলের বড় ভাই খাদেমুল ইসলামের নির্মাণাধীন বাড়িতে। সেখানে লাশ পুঁতে ফেলার জন্য আগে থেকেই একটি কক্ষে বালি খুঁড়ে গর্ত করে রাখা হয়েছিল।

র‌্যাব জানিয়েছে, কামরুল তার কিশোর বয়সী দুই ছাত্রকে ৩০০ টাকা করে দিয়ে ওই গর্ত খোঁড়ার কাজটি করিয়েছিলেন। তাদেরও র‌্যাব আটক করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, শিক্ষকের নির্দেশে তারা ওই কাজ করেছে।

রথীশচন্দ্র নিখোঁজ হওয়ার পর তার ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিক সুবল গত ১ এপ্রিল অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেছিলেন। দীপা, কামরুলসহ চারজনকে র‌্যাব পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার পর ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে কোতোয়ালি থানার ওসি বাবুল মিঞা জানিয়েছেন। 

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লাশের গলায় শুধু দাগ রয়েছে। তার পরনে শার্ট-প্যাণ্ট ও পায়ে জুতা ছিল। লাশ পেঁচানো ছিল বিছানার চাদর ও লুঙ্গি দিয়ে।”

রথীশের দুই সন্তনের মধ্যে ছেলেটি ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ছেন। ঘটনার সময় তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। আর ছোট মেয়ে পড়ালেখা করছে রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে। ঘটনার রাতে সে ছিল তার এক পিসির বাসায়।

বুধবার ময়নাতদন্তের পর রথীশের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। বিকালে দখিগঞ্জ শ্মশানে তার শেষকৃত হবে বলে ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিক জানিয়েছেন।