রংপুরে খাদেম হত্যায় ৭ জঙ্গির ফাঁসির রায়

তিন বছর আগে রংপুরের কাউনিয়ায় মাজারের খাদেম রহমত আলীকে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানাসহ সাত জঙ্গির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।

রংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2018, 06:49 AM
Updated : 18 March 2018, 12:35 PM

তবে নব্য জেএমবির আরেক নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীসহ এ মামলার অপর ছয় আসামিকে আদালত খালাস দিয়েছে। 

রংপুরের বিশেষ জজ আদালতের বিচারক নরেশচন্দ্র সরকার রোববার জনাকীর্ণ আদালতে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

মামলার অভিযোগপত্রে ১৫ আসামির নাম থাকলেও তাদের দুজন আগেই পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। বাকি ১৩ আসামির মধ্যে কারাবন্দি ১১জনকে রায়ের সময় আদালতে হাজির করা হয়।

রায়ে জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মামুন ওরফে মন্ত্রী (৩৩), ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া ওরফে রফিক (৩২), সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুল (৩০), সরোয়ার হোসেন সাবু ওরফে মিজান (৩৩), বিজয় ওরফে আলী ওরফে দর্জি (৩০) এবং পলাতক চান্দু মিয়াকে (২০) মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক।  পাশাপাশি তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

খাদেম রহমত আলী

বিচারক তার ৬৮ পৃষ্ঠার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, “ইসলাম শান্তির ধর্ম। সেই ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা মানুষ হত্যা করছে। অশান্তির সৃষ্টি করছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করাই তাদের উদ্দেশ্য।”

তিনি বলেন, “জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের বিরুদ্ধে এমন জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হওয়ায় সাত আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য বলে আমি মনে করি।”

রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ ‘প্রমাণ করতে না পারায়’ জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী (২৬), সাদাত ওরফে রতন মিয়া (২৩) ও তৌফিকুল ইসলাম সবুজ (৩৫), আবু সাঈদ (৩০), বাবুল আখতার ওরফে বাবুল মাস্টার (৩৫) এবং পলাতক রাজিবুল ইসলাম মোল্লা ওরফে বাদল ওরফে বাঁধনকে (২৫) খালাস দিয়েছেন বিচারক।

কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের চৈতার মোড়ে মাজার শরীফের খাদেম রহমত আলীকে (৬০) ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর রাতে বাড়ি ফেরার সময় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়।

এ মামলায় পুলিশ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার পর গত ১৬ বছরের অগাস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু করেন বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার।  

প্রতিক্রিয়া

এই রায় ঘিরে শনিবার রাত থেকেই রংপুর জজ আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। রোববার সকাল থেকে আদালতের সবগুলো ফটকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকতে দেখা যায়। আইনজীবী ও সংবাদকর্মী ছাড়া অন্য কাউকে রায়ের আগে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

সকাল সোয়া ৯টায় কারাগারে থাকা ১১ আসামিকে আদালতে নিয়ে আসার পর সোয়া ১০টায় রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। বেলা সোয়া ১২টায় দিকে আসামিদের সাজার ঘোষণা আসে।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক বলেন,“আমরা প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। এ রায়ের মাধ্যমে অপর জঙ্গিরা ধর্মের নামে মানুষ হত্যার মত অপরাধ থেকে বিরত থাকবে বলে আমরা আশা করছি।”

ছয় আসামির খালাসের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “আদালত বলেছে, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে তাদেরকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা নথিপত্র পর্যালোচনা করে পরে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”

মামলার বাদি অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বলেন, “ন্যায়বিচার পেয়েছি। সকলের সাজা হলে ভালো হত।”

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন ও আফতাব উদ্দিন বলেন, তারা ‘ন্যায্য বিচার’ পাননি। এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মাসুদ রানার স্ত্রী আলেমা বেগমও রায়ের সময় আদালত চত্বরে উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “অন্যায়ভাবে আমার স্বামীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে কোনোদিন জড়িত ছিলেন না। আমরা আপিল করব।”

আর বিজয় ওরফে আলীর মা মমেনা বেগম বলেন, “আমার ছেলে নির্দোষ। সে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল না। অন্যায়ভাবে তাকে জড়ানো হয়েছে।”

অন্য আসামিদের পরিবারের কেউ রায় নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।

ফাঁসির আসামি বিজয় ওরফে আলী

ফাঁসির আসামি লিটন মিয়া ওরফে রফিক

আসামি বৃত্তান্ত

খাদেম হত্যায় ফাঁসির রায় পাওয়া মাসুদ রানা, ইছাহাক আলী, লিটন মিয়া ও চান্দু মিয়ার বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পশুয়া টাঙ্গাইলপাড়া এলাকায়।

সাখাওয়াত হোসেন রাহুলের বাড়ি গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়ার চর এবং বিজয় ওরফে আলী ওরফে দর্জির বাড়ি গোবিন্দগঞ্জ এলাকায়। সরোয়ার হোসেন সাবু ওরফে মিজানের বাড়ি দিনাজপুরের বিরামপুরে।

রায় ঘোষণার সময় আসামিরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে করজোড়ে বিচারকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তবে তাদের চেহারায় তেমন কোনো অভিব্যক্তি ছিল না। আসামি ইছাহাক আলী কাঠগড়ায় উঠে গুণগুণ করে ধর্মীয় গান গাইতে শুরু করলেও পুলিশের ধমকে তা বন্ধ হয়ে যায়।

মৃত্যুদণ্ডের আসামিদের মধ্যে মাসুদ রানা, ইছাহাক, লিটন মিয়া ও সাখাওয়াত জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা মামলাতেও সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পেয়েছেন। গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকারই ওই রায় দেন।  

বিচারের ২৮ মাস 

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা বলেন, খাদেম রহমত আলী পীরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তার বাড়ির কাছে তার বাবা আব্দুস সাত্তারের নামে মাজার আছে। রহমত আলী ওই মাজারের খাদেম ছিলেন। এছাড়া তিনি কেরানীগঞ্জে ঈমান আল সুরেশ্বরী নামে এক পীরের মুরিদ ছিলেন।

“তিনি তার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর মাজার প্রাঙ্গণে ওরশের আয়োজন করতেন। জঙ্গিরা তা বন্ধ করতে একাধিকবার হুমকি দিয়েছিল। তা উপেক্ষা করে তিনি ওরশের আয়োজন করছিলেন। ওরশের ১১ দিন আগেই রহমতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।”

ওই হত্যাকাণ্ডের পরদিন তার ছেলে অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে কাউনিয়া থানায় মামলা করেন। প্রথমে মামলাটির তদন্ত করেন কাউনিয়া থানার এসআই মনোরঞ্জন রায়। পরে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মামুন অর রশীদকে।

তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১১ জুলাই জেএমবির ১৪ সদস্যের বিরুদ্ধে রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দেন তিনি। পরে মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা সাত মাস ধরে খাদেম রহমত আলীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর রাতে জঙ্গি বিজয় তাকে মাটিতে ফেলে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। পরে জঙ্গি মাসুদ গলা কেটে খাদেমকে হত্যা করেন। হত্যায় ব্যবহৃত তিনটি ছোরা পীরগাছার পশুয়া টাঙ্গাইলপাড়া এলাকায় মাসুদের বাড়ির পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

এ মামলার আসামি জেএমবির সদস্য নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে বাইক হাসান (২৬) ২০১৬ সালের ২ অগাস্ট ভোরে রাজশাহীতে এবং সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল (২১) গত বছরের ৫ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

তাদের নাম বাদ দিয়ে গত বছরের ১৬ অগাস্ট জেএমবির ১৩ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে এ মামলার বিচার শুরুর নির্দেশ দেন বিচারক। কিন্তু সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে বাদীর রিট আবেদনে হাই কোর্ট পুনঃতদন্তের আদেশ দেয়।

রংপুরের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আরমান হোসেন পুনঃতদন্ত শেষে জেএমবি সদস্য বিজয় ওরফে আলী ওরফে দর্জির নাম যুক্ত করে ১৩ জনের বিরুদ্ধে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। এরপর আবারও অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।  

৫২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্য দিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। এক সাক্ষীর মৃত্যু ও চার সাক্ষী ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের জন্য ১৮ মার্চ দিন ঠিক করে দেন।