নবতিপর একজন ভাষা সৈনিক সুমন্ত বসাক

ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পেরিয়ে গেলেও জয়পুরহাটের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা ভাষা সৈনিক সুমন্ত কুমার বসাকের খোঁজ কেউ রাখেনি। এতগুলো বছরেও সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে পাননি কোনো সম্মাননা।

মোমেন মুনি জয়পুরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2018, 04:38 PM
Updated : 21 Feb 2018, 04:39 PM

আক্কেলপুর উপজেলার রায়কালী গ্রামের এই ভাষা সৈনিকের জন্ম ১৯২২ সালের ২৫ জানুয়ারি। বাবা শ্রীমন্ত বসাক ও মা সরস্বতী বসাক।  

বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই সৈনিক ভাষা আন্দোলনের সেই সময়ের সংগ্রামী গানগুলো গেয়ে এখনও উজ্জীবিত হন।

তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরনো আমলের কাঠ ও কাপরের তৈরি হেলান দেওয়া এক ধরনের চেয়ারে (আরাম কেদারা) বসে পত্রিকা পড়ছিলেন।  

কুশলাদি জিজ্ঞেসের এক পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের কথা বলতেই গেয়ে ওঠেন- “রফিক, জব্বার, বরকতের রক্তে লেখা বাংলা ভাষার নাম.........”, “রফিক, শফিক, বরকত কত নাম....”, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি....”।

এ সময় তার চোক-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সুমন্ত বসাক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাবা রে, সে সময়ের কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি, ঢাকা থেকে সংগ্রামের আহবান এল, তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র আমি, সে সময় বগুড়ার ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, তার স্ত্রী জাহানারা হকসহ আমরা বেশ কয়েক জন তরুণ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বগুড়ার রাজ পথে মিছিল, মিটিং আর হরতালের পিকেটিংয়ে নেমে পড়ি।”  

পার্শ্ববর্তী কাশিরা গ্রামের আব্দুস সামাদ তালুকদার (৮০), রায়কালী গ্রামের নৃপেন্দ্রনাথ মহন্ত (৮৫), সুমন্ত বসাকের স্ত্রী নিশা রানীসহ (৮২) অনেক প্রবীণ এলাকাবাসী জানান, চঞ্চল প্রকৃতির এই মানুষটি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীসহ তৎকালীন সংগ্রামী নেতৃবৃন্দের সান্নিধ্যে থেকে ১৯৫২ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণিতে পড়ার সময় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন।

তারা জানান, ওই সময় তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে তিনি ফেরার হওয়ায় ওই বছর উচ্চ মাধ্যমিক (ইন্টারমিডিয়েট) পরীক্ষা দিতে পারেননি। পরের বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় রায়কালী গ্রামে নবগঠিত উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।

স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর একই স্কুলে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। উচ্চ বেতনের বড় বড় চাকরির সুযোগ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করে এই অজ পাড়াগাঁয়ে থেকে যান বলে তার সেই সময়ের এই প্রতিবেশী ও নিকটজনরা জানান।

বাড়ির আঙিনায় বসে পত্রিকা পড়ছেন সুমন্ত কুমার বসাক

চার ছেলে ও এক মেয়ে নিজ নিজ কর্মে নিয়োজিত। কিন্তু সুমন্ত বসাক বাবার ভিটা ছেড়ে তাদের সঙ্গে কোথাও যেতে চান না। ভাষা আন্দোলেনের স্মৃতি বুকে ধারণ করে এখনও জন্মভূমিতে আছেন।

মাতৃভাষার চর্চা নিয়ে আক্ষেপ ঝরে পড়ল তার মুখে।

“কত রক্তের বিনিময়ে, এত ত্যাগ স্বীকার করে অর্জিত এ ভাষা চর্চার অভাবে দিনদিন দৈন্য হয়ে পড়ছে। যান্ত্রিক সভ্যতা আর স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আগ্রাসনে বাংলা চর্চায় ভাটা পড়ে যাচ্ছে।” 

এছাড়া ভাষার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন তাদের খোঁজখবর পর্যন্ত নেওয়া হয় না বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

“পরন্ত বেলায় আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, এক সময় আমি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য পেয়েছি। তাই শেষবারের মত বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বচক্ষে একটিবারের মত দেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাই।” 

এলাকাবাসী জানান, ভাষা আন্দোলন পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রায়কালী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করে ১৯৯১ সালে অবসরে যান সুমন্ত কুমার বসাক। মহান ভাষা আন্দোলনের এই সৈনিককে শেষ বয়সে হলেও যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার দাবি এলাকাবাসীর।

জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক মোকাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সৈনিকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে।