২৮ বছরে শাবি: মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন বহুদূরে

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২৭ বছর পূর্ণ করেছে মঙ্গলবার।

হোসাইন ইমরান, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Feb 2018, 02:46 PM
Updated : 14 Feb 2018, 05:10 AM

১৯৮৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি (পহেলা ফাল্গুন) প্রতিষ্ঠিত হয় উচ্চশিক্ষার এ প্রতিষ্ঠান। ৩২০ একর বিস্তৃত এই ক্যাম্পাসে তিনটি বিভাগে ১২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯১ সালে।

কিন্তু প্রতিষ্ঠালগ্নে গৃহীত ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে এখনও অনেক দূরে রয়েছে।

‘বিশ্ববিদ্যালয় আইন ১৯৮৭’ তে শিক্ষা-গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ছয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১৯৮৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ‘মহাপরিকল্পনা’র বাস্তবায়ন করার কথা উল্লেখ করা হয়। সময়সীমার এক বছর বেশি পেরিয়ে গেলেও তার বাস্তবায়ন ঘটেনি।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এইচ এম বেলায়েত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উন্নত দেশগুলোতে মহাপরিকল্পনা নিলে বাস্তবায়নের জন্য একটি মিশন/ভিশন থাকে।

“আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় নেওয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো মিশন/ভিশন ছিল না। এছাড়া গৃহীত মহাপরিকল্পনাও পরিপূর্ণ ছিল না।

“এখনও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মিশন/ভিশন নাই। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মনে করা হয়, কোনরকম শিক্ষকদের বেতন আর ক্লাস নিতে পারলেই সব কাজ শেষ; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে গবেষণা।”

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বিভাগের ক্লাসরুম নাই, শিক্ষকদের বসার জায়গা নাই, ক্যাম্পাসে ক্যান্টিন নাই, যে ভবনগুলো তৈরি হয়েছে তাও আবার অপরিকল্পিতভাবে। এগুলোতে মেয়েদের জন্য আলাদা বাথরুম নাই।

“বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলে, বাজেট বাড়লে গবেষণার মান বাড়বে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে হাইস্কুলে পরিণত করে রাখলে চলবে না।”

মহাপরিকল্পনার মধ্যে ছিল- ছয়টি স্কুল ও দুটি ইনস্টিটিউটের অধীনে ৩৭টি বিভাগ চালু, সাত হাজার শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা, ১৭টি একাডেমিক ভবন, ছয়টি ছাত্র ও তিনটি ছাত্রী হল এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ২৮টি ভবন নির্মাণ।

মহাপরিকল্পনার বিপরীতে বিগত সময়ে ২৯টি বিভাগ, মাত্র ছয়টি একাডেমিক ভবন, দুইটি ছাত্রী ও তিনটি ছাত্রহল (একটি অসম্পূর্ণ), শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য একটি ডরমেটরি ও তিনটি চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে ১০ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে পাঁচটি হলের আসন সংখ্যা ১৮৫০। এর মধ্যে শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা হল না ছাড়ায় আবাসন সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে।

সঙ্কট নিরসনে ছাত্রীদের জন্য শহরে দুটি ভবন ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এসব ভবনে থাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চড়া মূল্যে ভাড়া আদায় করা হয় বলে প্রভোস্টদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের।

ভাড়া করা ভবন ‘ফজল কমপ্লেক্স’র আবাসিক শিক্ষার্থী ফারাহ হাসান দিবা বলেন, “চার সিটের রুমে প্রত্যেককে ১৫৫০ টাকা করে ভাড়া দিতে হয়, যা আমাদের জন্য অনেক বেশি। দ্বিতীয় বর্ষের মধ্যে হলে সিট দেওয়ার কথা থাকলেও সিনিয়াররা হল না ছাড়ায় তৃতীয় বর্ষে এসেও হলে উঠতে পারিনি। এ বিষয়ে হলের প্রভোস্টরাও কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বাস রয়েছে মাত্র সাতটি। সঙ্কট নিরসনে বিআরটিসি থেকে ভাড়া করা হয়েছে আরও আটটি বাস। এসব বাস ভাড়া করে ট্রিপ প্রতি ১৩৫০ টাকা করে প্রতিদিন অর্ধলক্ষাধিক টাকা খরচ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জুয়েল রানা বলেন, বাসগুলো জীর্ণশীর্ণ হওয়ায় প্রায়ই মাঝপথে নষ্ট হয়ে যায়। নষ্ট বাসগুলো ভাড়া করে অর্ধলক্ষাধিক টাকা খরচ করা হচ্ছে প্রতিদিন। দুই/এক মাসের টাকা দিয়ে নতুন বাস কেনা যায়। অথচ কর্তৃপক্ষ নতুন বাস কিনছে না। সঙ্কট নিরসনে অন্তত ৩০টি বাস দরকার।

নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ না করে খোলা হচ্ছে নতুন নতুন বিভাগ। ফলে স্থান সঙ্কট তীব্র হওয়ায় নতুন বিভাগে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ পাচ্ছে না।

গত বছর থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ। এই বিভাগের তিনজন শিক্ষকদের বসার জন্য নেই কোনো কক্ষ, নেই ল্যাব রুম। ক্লাসরুম রয়েছে মাত্র একটি।

এ বিভাগের প্রভাষক সুলাইমান হোসাইন বলেন, “আমরা কোনোমতে একটি রুমে ক্লাস নিয়ে আমাদের একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। নতুন একটি ব্যাচ আসায় এখন ক্লাস রুমের সঙ্কট তীব্রভাবে দেখা দিয়েছে।” 

বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই নিজস্ব কোনো গবেষণাগার। লাইব্রেরি ভবনের নিচতলায় কয়েকটি রুম নিয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। এছাড়া ‘সেন্টার অব এক্সিলেন্স’ ও ‘ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি অব এসিউরেন্স সেল’র (আইকিউএসি) শিক্ষকরা স্থান সংকটের কারণে লাইব্রেরি ভবনের নিচতলায় শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

আইকিউএসি’র পরিচালক অধ্যাপক আবদুল আউয়াল বিশ্বাস বলেন, “আমাদের শিক্ষা-গবেষণার কার্যক্রমে অনেক অপ্রাপ্তি আছে, সঙ্কট আছে। এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে এবং পর্যাপ্ত বাজেট হলে শিক্ষা-গবেষণায় এ বিশ্ববিদ্যালয় অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে।”

প্রতি সেমিস্টারে শাকসুর জন্য শিক্ষার্থীরা ৫০ টাকা করে জমা দিলেও শাহজালাল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (শাকসু) নির্বাচন দীর্ঘ ২১ বছর ধরে হচ্ছে না। এ টাকা কোথায় যায় তাও জানেন না শিক্ষার্থীরা।

প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর নির্মাণ হয়নি সীমানা প্রাচীর। চারদিক অরক্ষিত থাকায় সহজেই ছিনতাই করে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। গত বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে অস্ত্রের মুখে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী।

ক্যাম্পাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরে খাবারের জন্য নেই স্বাস্থ্যসম্মত ক্যান্টিন। ক্যাফেটিরেয়িার খাবারের দাম অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

ট্র্যাকিং ডিভাইস, ঘরে বসে ফি অনলাইনে জমা দিতে ইলেকট্রনিক পেমেন্ট বা ই-পেমেন্ট সার্ভিস চালুর ঘোষণা দিলেও তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

সার্বিক বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদে বলেন, “আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণা ও অবকাঠামোর উন্নয়নে নতুন করে ‘মহাপরিকল্পনা’ তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আশা করি এতে বড় বাজেটের প্রকল্প আমরা পাব।”

“প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর দুটি করে বাস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া ২৩৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন হলে আবাসন ও পরিবহন ব্যবস্থায় সঙ্কট থাকবে না।”