বুধবার দুপুরে নগর ভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন আইভী; শামীম ওসমান বিকালে চাষাঢ়া রাইফেল ক্লাবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আইভী দাবি করেছেন, মঙ্গলবার তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই হামলা চালানো হয়েছিল এবং এর পেছনে ছিলেন শামীম ওসমান।
অন্যদিকে নগর আওয়ামী লীগের নেতা শামীমের দাবি, সংঘর্ষ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে হকারদের; তার সঙ্গে আইভীর ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই।
তবে এই সংঘর্ষ যে বিবাদমান এই দুই নেতার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ, তা উঠে এসেছে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কথায়।
নারায়ণগঞ্জের সংঘর্ষ নিয়ে বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার যতদূর মনে হয়, তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে এই ঘটনাটা ঘটতেছে।”
এই সমস্যার সমাধানে কেন্দ্র থেকে হস্তক্ষেপের কথাও বলেন মন্ত্রী মোশাররফ।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। আইভী ও শামীম দুজনকেই ঢাকায় ডাকা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে উত্তরাধিকার সূত্রে বিরোধ লালন করছেন প্রভাবশালী দুই পরিবারের সদস্য আইভী ও শামীম। প্রায় দশককাল আগে দুজন একসঙ্গে মেয়র প্রার্থী হলে বিরোধ প্রকট হয়।
সম্প্রতি সিটি করপোরেশন ফুটপাত থকে হকার উচ্ছেদে নামলে তার বিরোধিতায় নামেন শামীম। শামীম হকারদের বসানোর ঘোষণা দিলে মঙ্গলবার সেখানে দলবল নিয়ে যান আইভী। তখন প্রথমে তার উপর হামলা হলে বেঁধে যায় সংঘর্ষ।
‘উদ্দেশ্য ছিল আমাকে হত্যা’
নগর ভবনে সংবাদ সম্মেলনে আইভী দাবি করেন, তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ওই হামলা চালানো হয়েছিল।
“আমার চোখের সামনে নিজের দুই ভাই, আত্মীয়-স্বজনও কাছের কর্মীদের রক্তাক্ত করা হয়েছে। মুখ চিনে চিনে তাদের উপর হামলা করা হয়েছে।”
পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মেয়র আইভী।
“এক থেকে দেড়শ নেতাকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হয়েছে। কিস্তু পুলিশের কোনো ভূমিকা ছিল না। আমি এই ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
হামলার সময় অস্ত্র হাতে যে নিয়াজুলের ছবি এসেছে, তাকে এখনও গ্রেপ্তার না করার সমালোচনাও করেন আইভী।
“তিনি (শামীম) বলতে চাচ্ছেন, হকারদের সাথে আইভীর লোকজনের সংঘাত হয়েছে। তাহলে নিয়াজুল কে? সে কার লোক? তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে আসবে। নিয়াজুলকে ধরলেই তো সে কার লোক, কার নির্দেশে আমাকে হত্যা করতে এসেছিল, তা বেরিয়ে আসবে।
“নিয়াজুল আমার থেকে মাত্র দুই গজ দূরে অস্ত্র হাতে নিয়ে তেড়ে এসেছে। এটা নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিকসহ শহরবাসী দেখেছে।”
তিনি জেলা প্রশাসক (ডিসি ) ও পুলিশ সুপারকে (এসপি) প্রত্যাহারের দাবি করেন।
শামীম ওসমানের ‘লোক’ নিয়াজুলের অস্ত্র প্রদর্শনের বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, “অস্ত্র প্রদর্শন বিষয়ে থানায় জিডি করা হয়েছে। অস্ত্রের উৎস ইত্যাদি তদন্ত করা হচ্ছে।”
দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন।
আইভী বলেন, “আগের দিন শামীম ওসমান হকার, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের উস্কে দিয়েছে বলেই এমন ঘটনা ঘটেছে।”
হকার সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমেই করতে চেয়েছিলেন বলে দাবি মেয়র আইভীর।
“তার ভাই এমপি সেলিম ওসমান হকার বিষয়ে আমাকে চিঠি দিয়েছে। আমি ওই চিঠির উত্তরও দিয়েছি। চিঠিতে তার প্রস্তাবনা ছিল, আমারও প্রস্তাবনা ছিল। আলোচনা করেই সমস্যার সমাধান হত। কিন্তু অন্য আসনের এমপি (শামীম ওসমান) কেন হকার নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু করল?
“হকার্সদের পুনর্বাসনের জন্য চাষাঢ়া হকার্স মার্কেট করে দিয়েছি। প্রয়োজনে সেই মার্কেট ১০ তলার করার পরামর্শ দিয়ে শামীম ওসমান আমাকে সহযোগিতা করার কথা বলতে পারত। কিন্ত তা না করে তার লোক দিয়ে হামলা করাল। এখন হামলার ঘটনা হকারদের উপর চাপানোর চেষ্টা চলাচ্ছে শামীম ওসমান।”
‘নিয়াজুলের অস্ত্র আত্মরক্ষায়’
সংঘর্ষে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করার পাশাপাশি শামীম ওসমান দাবি করেছেন, নিয়াজুল ইসলাম আত্মরক্ষায় অস্ত্র বের করেছিলেন।
তিনি বলেন, “নিয়াজুল এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাকে আইভীর প্রিয় বন্ধু সুফিয়ানসহ বিএনপির ক্যাডাররা ধরে তিন দফা মারধর করেছে। চতুর্থ দফায় সে আত্মরক্ষার্থে পিস্তল বের করেছে। কিন্তু কোনো গুলি ছোড়ে নাই। সরকার তাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছে তো আত্মরক্ষার্থে।”
নিয়াজুলের পরিচয় তুলে ধরে শামীম বলেন, “নিয়াজুল আওয়ামী লীগের সাহসী নেতা নজরুল ইসলাম সুইটের ছোট ভাই। যে সুইট বিএনপি শাসন আমলে খালেদা জিয়াকে কালো পতাকা দেখিয়েছিল। সুইটকে জেলখানা থেকে বের করে এনে র্যাব দিয়ে রাস্তার উপর গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। নিয়াজুল ভাই হত্যার বিচার পায় নাই।
“তাদের পরিবারের কেউ রাজনীতিতে নাই। সে বিশাল মার্কেটের মালিক ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আর এখন বলা হচ্ছে, সে নাকি আইভীকে মারতে সেখানে গিয়েছিল।”
সংবাদ সম্মেলনে একটি ছবি দেখিয়ে শামীম বলেন, আইভীর সমর্থক ঠিকাদার আবু সুফিয়ানের কোমরেও পিস্তল ছিল।
“তার (আইভী) সবচাইতে কাছের লোকটা, প্রিয় বন্ধু ….. এই ছবিটা… সুফিয়ান তার কোমর থেকে পিস্তল বের করে…. সুফিয়ানের কোমরে পিস্তল; পিস্তল নিয়ে কেন আসবে?”
তবে সেই ছবি সাংবাদিকদের সরবরাহ করা হয়নি।
শামীম দাবি করেন, আইভী বিএনপির লোকদের নিয়ে চাষাঢ়ায় এসেছিলেন মঙ্গলবার।
তিনি বলেন, “কেউ কেউ সিটি কর্পোরেশন আর হকারদের ঝামেলাকে আইভী বনাম শামীম ওসমানের ঝগড়া বলে চালানোর চেষ্টা করছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, আইভীর সাথে শামীম ওসমানের ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই। হকারদের সঙ্গে আইভীর লোকজনের সংঘর্ষ হয়েছে।”
এক্ষেত্রে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে এই সংসদ সদস্য বলেন, “আমি গরিব মানুষের পক্ষে ছিলাম এবং আছি। আমার দাবি, আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত হকার বসতে দিতে হবে। এরপর তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন।”
তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে ফুটপাতে হকার বসার পক্ষে না। এই হকারদের বড় পরিচয় হলো তারা মানুষ। গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে নারায়ণগঞ্জে হঠাৎ করে কোনো নোটিস ছাড়া এই হকারদের উচ্ছেদ করা হয়।
“সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা হকারদের শীতের মৌসুমের গরম কাপড়, মালামাল তুলে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তখন আমার কাছে হকাররা এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ হকারদের দায়িত্ব নিয়েছে বাম মোর্চা। আইভীকে আইভী বানানোর পেছনে বাম মোর্চার নেতাদের অনেক বড় হাত রয়েছে। তাই আমি ভেবেছিলাম তাদের নেতৃত্বেই হকাররা সফল হবে। কিন্তু হয় নাই।”
এরপর হকারদের পক্ষে নামেন বলে জানান শামীম।
“আমি বলেছি, পুনর্বাসনের আগ পর্যন্ত তাদের বসতে দিন। এদের কিছু সময় দিন, এরা এদের ঋণের টাকা উঠিয়ে আনুক। কারণ আমার রাজনীতি হল গরিবের পক্ষে থাকা।”
আইভীর নানা অভিযোগের প্রেক্ষাপটে শামীম বলেন, “প্রথমটায় কী হয়েছে, দ্বিতীয়টায় কী হয়েছে? কোন স্টাইলে নির্বাচন হয়েছে! সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। কোথায় কী হয়েছে, এখনও মুখ খোলার সময় হয় নাই। একটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। তারপর সব বলব।”