কনকনে শীতে ইজতেমামুখী মানুষ

কনকনে শীত আর ঘন কুয়াশা উপেক্ষা করে লাখো দেশি-বিদেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন।

আবুল হোসেন গাজীপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2018, 03:14 PM
Updated : 12 Jan 2018, 03:14 PM

শুক্রবার শুরু হওয়া ইজতেমা রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এর আগ পর্যন্ত মানুষের আগমন অব্যাহত থাকে। 

ফজরের নামাজের পর জর্ডানের মাওলানা শেখ ওমর খতিবের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠিকতা শুরু হয়। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন।

ইজতেমার প্রথম দফা রোববার (১৪জানুয়ারি) শেষ হবে। চারদিন পর ১৯ জানুয়ারি শুরু হবে ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব, যা ২১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে।

প্রথম পর্বে অংশ নিচ্ছেন দেশের ১৪ জেলার মানুষ।

তীব্র শীতের কারণে এবার বিশ্ব ইজতেমায় মানুষের আগমন কিছুটা কম হবে বলে ধারণা করছেন ইজতেমা কর্তৃপক্ষ।

বৃহত্তম জুমার নামাজ

প্রথম দিন দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

ইজতেমার মুরুব্বী প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন জানান, কাকরাইল মসজিদের মাওলানা হাফেজ মো. জোবায়ের দেড়টার দিকে জুমার নামাজ শুরু করেন।

শুক্রবার ভোর থেকে বিশ্ব ইজতেমার জুমার নামাজে অংশ নিতে গাজীপুর ও আশপাশের মানুষ হেঁটে ও যানবাহনে করে টঙ্গীমুখী হয়। দুপুরের আগে ইজতেমাস্থলে টুপি-পাঞ্জাবী পরা মানুষের ঢল নামে। 

জুমার নামাজে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আজমত উল্লাহ খানসহ স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইজতেমা ময়দানে জুমার নামাজে অংশ নেন।

ইজতেমা স্থলে ২ জনের মৃত্যু

বিশ্ব ইজতেমার মাসলেহাল জামাতের সদস্য মো. আদম আলী জানান, শ্বাসকষ্টজনিত রোগে বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে আজিজুল হক (৬০) নামের একজন মারা গেছেন। তার বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার হবিশপুর গ্রামে।

ফজরের নামাজের পর ইজতেমা ময়দানে তার জানাজা নামাজ শেষে লাশ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।

টঙ্গী থানার এএসআই  মো. আলমগীর নাজির বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় আব্দুল মামুন ওরফে মনা (৩৩) নামের এক ব্যক্তি গাড়িচাপায় নিহত হয়েছেন।

নিহত মামুন ঢাকার পশ্চিম আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা কেরামত আলীর ছেলে। তিনি ইজতেমায় যোগ দিতে আসছিলেন বলে জানান আলমগীর।

টঙ্গীতে যানজট

গাজীপুর ট্রাফিক বিভাগের এএসপি মো. সালেহ উদ্দিন আহমদ জানান, দুপুরে জুমার নামাজ পড়তে আসা মানুষ ও গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় যান চলাচল সাময়িকভাবে বিঘ্নিত হয়। জুমার পরে একসঙ্গে ফিরতে গিয়ে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় গাড়ির চাপ বেড়ে যায় এবং দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।

পরে অনেকে হেঁটে টঙ্গী এলাকা অতিক্রম করে দক্ষিণে আব্দুল্লাহপুর এবং উত্তরে চেরাগ আলী এলাকায় গিয়ে গাড়িতে ওঠেন। সাড়ে ৩টার দিকে যানজট অনেকটা স্বাভাবিক হয় বলে জানান সালেহ উদ্দিন। 

ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্পে রোগীর ভিড়

শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল ছাড়াও ইজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকায় স্থাপিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের অর্ধশতাধিক মেডিকেল ক্যাম্পে হাজারো রোগীকে ভিড় করতে দেখা গেছে।

হামদর্দ ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্পে কর্মরত চিকিৎসক মো. মুনিরুজ্জামান খান বলেন, ইজতেমায় আসা অধিকাংশ মনুষের সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তারা দুইদিনে প্রায় ১৫ হাজার রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়েছেন।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মেডিকেল কমিটির চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের চিকিৎসক মো. নজরুল ইসলামও একই কথা বলেন।

ইজতেমা এলাকায় গাজীপুর সিভিল সার্জন অফিস, ইবনে সিনা, টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, গ্রামীণফোন, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় অর্ধশত ফ্রি-মেডিকেল ক্যাম্পে পুণ্যার্থীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ১১শ ৪২ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন এবং ৪৮ জন ভর্তি রয়েছেন। এছাড়া তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

গাজীপুরে যান চলাচল নির্দেশনা

ইজতেমায় আগতদের যানবাহন পার্কিংয়ের জন্য ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে উত্তবঙ্গ থেকে আসা টঙ্গী-ঢাকাগামী যানবাহন চান্দনা-চৌরাস্তা হয়ে কোনাবাড়ি, চন্দ্রা-ত্রিমোড়, বাইমাইল, নবীনগর ও আমিনবাজার হয়ে চলাচল করবে।

এছাড়া ১১-১৩ জানুয়ারি এবং ১৮-২০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাস্তুহারা থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত মহাসড়ক, স্টেশন রোড ওভারব্রিজ থেকে টঙ্গী রেলগেট, মুন্নু ট্রেক্সটাইল মিল থেকে কামারপাড়া ব্রিজ পর্যন্ত সড়কে মোটরযান ছাড়া রিকশা, ভ্যান ইত্যাদি চলাচল বন্ধ থাকবে।

আখেরি মোনাজাতের দিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা-চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত কালীগঞ্জ-টঙ্গী সড়কের মাজুখান ব্রিজ থেকে স্টেশন রোড ওভারব্রিজ পর্যন্ত এবং কামারপাড়া ব্রিজ থেকে মুন্নু টেক্সটাইল মিলগেট পর্যন্ত সড়কপথ বন্ধ থাকবে।

এর আগে ১৩জানুয়ারি এবং ২০ জানুয়ারি রাত ১০টা থেকে টঙ্গীর নিমতলী রেলক্রসিং, কামারপাড়া ব্রিজ ও ভোগড়া বাইপাস দিয়ে ইজতেমাস্থলের দিকে সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে পুণ্যার্থীদের নিয়ে ইজতেমাস্থলের দিকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত শাটল বাস চলাচল করবে। তবে বিকল্প হিসেবে ভোগড়া বাইপাস দিয়ে কোনাবাড়ি ও চন্দ্রা হয়ে এবং বিপরীত দিকে ৩০০ ফুট রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে।

নৌযান চলাচলে নির্দেশনা

২১ জানুয়ারি পর্যন্ত কামারপাড়া সেতু থেকে টঙ্গী সেতু পর্যন্ত তুরাগ নদীতে সকল প্রকার নৌযান চলাচল ও নোঙর বন্ধ থাকবে। এ নির্দেশনা কার্যকর শুরু হয়েছে ৯ জানুয়ারি। প্রয়োজনে নৌযানসমূহ টঙ্গী সেতুর পূর্ব পাশে এবং কামারপাড়া ব্রিজের উত্তর পাশে নোঙর করতে পারবে। নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও সদরঘাট থেকে ৬টি ওয়াটার বাস টঙ্গী পর্যন্ত পুণ্যার্থীদের বহন করবে।

পাঁচ হাজারের বেশি বিদেশি

গাজীপুর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির জানান, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বাইরের দেশের পাঁচ হাজারের বেশি পুণ্যার্থী এবার ইজতেমা মাঠে এসে পৌঁছেছেন।

প্রথম পর্বে দেশের ১৪ জেলার পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, জর্ডানসহ বিশ্বের ৭২টি দেশের মানুষ ইজতেমায় এসেছেন। বিদেশিদের আগমন অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান।

জেলা প্রশাসক বলেন, প্রথম দিনে কোথাও কোনো গোলযোগ সৃষ্টি হয়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুইটি কন্ট্রোল রুম থেকে ইজতেমার সকল কার্যক্রম মনিটরিং করা হচ্ছে। ওই এলাকায় প্রতিদিন দুইবেলায় ১০টি মোবাইল কোর্ট চলছে। এখানে ১৫ জন ম্যাজিস্ট্রেট মোতায়েন রয়েছেন।

আখেরি মোনাজাত

ইজতেমা মাঠের মুরুব্বী প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন জানান, ভারতের মাওলানা সাদ বিশ্ব ইজতেমায় অংশ না নেওয়ায় আগামী রোববার প্রথম পর্বের মোনাজাত পরিচালনা করবেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা জুবায়ের।

দুই ধাপে অংশ নেবেন দেশের ২৭ জেলার মানুষ। প্রথম ধাপে অংশ নিচ্ছেন বিদেশিসহ এদেশের ১৪ জেলার মানুষ।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও ভিডিপি পৃথক ৫টি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করেছে। ইজতেমায় আগতদের ওজু, পয়ঃনিষ্কাষণ ও সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য ইজতেমা মাঠে স্থাপিত ১৩টি গভীর নলকূপ দিয়ে ১৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটিার পাইপ লাইনের মাধ্যেমে প্রতিদিন ৩ কোটি ৫৪ লাখ গ্যালন সুপেয় পানি সরববরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ইজতেমা চলাকালীন ২১টি গার্বেজ ট্রাক বর্জ্য অপসারণ কাজে মোতায়েন রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের গাজীপুরের উপ সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, বিশ্ব ইজতেমায় আগতদের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা, উদ্ধার, রোগী পরিবহন (অ্যাম্বুলেন্স), তুরাগ নদে দমকল বাহিনীর ডুবুরি টহলসহ বিভিন্ন ইউনিট প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, শুক্রবার শান্তিপূর্ণভাবে এবারের ইজতেমার প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে। এদিন কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। তবে ইজতেমা স্থলের আশপাশের শতাধিক হকার ও ভিক্ষুক উচ্ছেদ করা হয়েছে। প্রথম দিনে ৭০ জনের মত হকার আটক করা হয়েছে।

নিরাপত্তায় পুলিশের ৭ হাজার সদস্য ও র‌্যাবের ২৫০ থেকে ৩০০ জন সদস্য মাঠে মোতায়েন থাকবে। এ বছর গতবারের চেয়ে প্রায় দেড় হাজার পুলিশ সদস্য ও ৫টি ওয়াচ টাওয়ার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া ৪১টি স্থায়ী সিসি ক্যামেরা ইজতেমা মাঠের চারপাশে স্থাপন করা হয়েছে।

প্রথম দফায় ১৪ জেলার মানুষ

প্রথম দফায় অংশগ্রহণকারী জেলাগুলো হলো- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, শেরপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, নড়াইল, মাগুরা, পঞ্চগড়, নীলফামারী ও নাটোর।

ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম কোণে বিদেশি মেহমানদের জন্য এবার তৈরি করা হয়েছে চার কামরাবিশিষ্ট বিদেশি নিবাস। সেখানে টেলিফোন সংযোগ, গ্যাস সংযোগ, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, উন্নত টয়লেট ব্যবস্থাসহ সকল আধুনিক সুবিধাদি রয়েছে।