এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি শহরজুড়ে দফায় দফায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় স্থানীয় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা। পুরো শহর সেদিন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, সঙ্গীতজ্ঞ উস্তাদ আলউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরের পাঁচটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয় ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালায় তারা।
পুলিশ জানায়, এসব ঘটনায় দায়ের করা ১৬ মামলায় নাম উল্লেখ করে ১৬২ জন এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও সাত হাজার ১৫০ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ৩২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরবর্তীতে বেশিরভাগই জামিনে ছাড়া পেয়েছে।
মামলাগুলোর একটিতেও এখনও তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারেনি পুলিশ।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ওসি মো. নবীর হোসেন বলেন, “সবগুলো মামলা স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে আমাদের তদন্ত কাজে বেশি সময় লাগছে।”
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি বিকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে চালকের সঙ্গে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার এক ছাত্রের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে জেলা পরিষদ মার্কেটের বিজয় টেলিকমের মালিক ওই ছাত্রকে থাপ্পর দেন। এর জেরে সন্ধ্যায় অর্ধশত ছাত্র বিজয় টেলিকমে ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের শান্ত করতে চাইলে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এক পর্যায়ে তা রূপ নেয় সংঘর্ষে।
কয়েক দফার ওই সংঘর্ষে তিন পুলিশসহ অন্তত ২০ জন আহত হন।
পরদিন (১২ জানুয়ারি) ভোরে জেলা সদর হাসপাতালে হাফেজ মাসুদুর রহমান (১৮) নামে আহত এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যু হয়।
ওই সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার এস এম মহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একদল মাদ্রাসা ছাত্র অতর্কিতভাবে রেলওয়ে স্টেশনে এসে হামলা চালায়। এ সময় তারা স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফরমের দরজা-জানালা, স্টেশন মাস্টারের কক্ষ, প্যানেল বোর্ড, টেলিফোন ও চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে। এছাড়া তারা স্টেশন সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে।
এতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রেলপথে দীর্ঘ সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।
সেখান থেকে তারা উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে গিয়ে চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে এবং সঙ্গীতাঙ্গনের জাদুঘরে সংরক্ষিত উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র সরোদ ও জায়নামাজসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। একই সময়ে শিল্পকলা একাডেমি ও ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বরের পাঁচটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে ভাঙচুর করে বলেও অভিযোগ করা হয়।
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়, একইদিন বিকালে হাসপাতাল থেকে নিহত মাদ্রাসা ছাত্রের মরদেহ দেওয়া হচ্ছে না বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা শহরের টিএ রোডে ফকিরাপুলে দাঁড়ানো একটি পুলিশ পিকআপ ভ্যানে আগুন দেয়। একই সময়ে জেলা সদর হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়।
এদিকে, সদর মডেল থানার তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) তাপস রঞ্জন ঘোষ ও ওসি আকুল চন্দ্র বিশ্বাসের প্রত্যাহারের দাবিতে হরতাল ডাকে কওমি ইসলামী ছাত্র ঐক্য পরিষদ।
বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্রদের নিবৃত করতে ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসায় বৈঠকে বসে জেলা প্রশাসন। প্রায় দুই ঘণ্টার ওই বৈঠকে এসএসপি তাপস এবং ওসি আকুলকে প্রত্যাহার এবং নিহত ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস পেয়ে হরতাল প্রত্যাহার করে তারা।
“দুই বছরেও তাদের বিচার না হওয়ায় আমরা ক্ষুব্ধ। দ্রুত এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের সহকারী পরিচালক ও আরেকটি মামলার বাদী বাছির দুলাল বলেন, “দুই বছর পেরিয়ে গেছে অথচ পুলিশ প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না। এ তাণ্ডবের সুষ্ঠু বিচার নিয়ে আমরা শঙ্কিত।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি জয়দুল হোসেন বলেন, যদি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হতো তাহলে নাসিরনগরে মৌলবাদী হামলা হতো না।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহবায়ক আবদুন নুর বলেন, “আমি মামলার একজন বাদী। কিন্তু দুই বছরেও পুলিশের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।”