শেষ বয়সে এসে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চাইছেন মানবসেবায় নিয়োজিত এ দুই ব্রিটিশ।
১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে জন্ম লুসি হল্টের। বাবা জন হল্ট ও মা ফ্রান্সিস হল্ট।
৮৭ বছর বয়সী লুসি জীবনের ৫৭ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশে; এদেশের মাটি ও মানুষকে ভালবেসে যুগের পর যুগ ভুলে থেকেছেন পরিবারকে।
তাই মৃত্যুর আগে তার একটাই চাওয়া ‘দ্বৈত নাগরিকত্ব’।
রোববার দুপুরে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় লুসি হল্টের।
তিনি বলেন, মানুষের সেবা করার জন্য ১৯৬০ সালে বরিশালের অক্সফোর্ড মিশনে যোগ দেন তিনি। এটাই তার প্রথম বাংলাদেশে আসা। অক্সফোর্ড মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের পড়াতেন তিনি।
২০০৪ সালে অবসরে যাওয়ার আগে খুলনা, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ ও ঢাকায় কাজ করেছেন লুসি হল্ট। অবসর জীবনে তিনি বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের শিশুদের মানসিক বিকাশ ও ইংরেজি শিক্ষা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের কাছে তার কী চাওয়ার আছে- জানতে চাইলে লুসি হল্ট বলেন, অবসরের পর সবাই দেশে ফিরে গেলেও তিনি যাননি। বাংলাদেশে ও বরিশালের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক।
“তাই বাকি জীবনটা বরিশালেই কাটিয়ে দিতে চাই। মৃত্যুর পরে এখানেই যেন চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।”
লুসি হল্টের এক সময়ের ছাত্রী ৫৯ বছরের উষা দাস বলেন, তিনি (লুসি হল্ট) শুরু থেকেই মানুষের সেবা করেছেন, এখনও মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন। তাকে দেশে ফিরে যাওয়ার কথা বললেই তিনি কাঁদেন। এদেশের মায়ায় জড়িয়ে গেছেন।
অবসরকালীন ভাতা সাড়ে সাত হাজার টাকা দিয়েই তার জীবন চলছে জানিয়ে উষা বলেন, এই স্বল্প ভাতার টাকা থেকে প্রতিবছর ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ৩৮ হাজার টাকা দিতে হয়, যা তার জন্য কষ্টকর।
এ অবস্থায় তাকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেয়ার দাবি জানান উষা।
বাংলাদেশ ও মানুষের প্রতি লুসি হল্টের ভালবাসায় মুগ্ধ বরিশালের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান।
“আমি কাগজপত্র প্রায় প্রস্তুত করে ফেলেছি। সার্বিক বিষয় উল্লেখ করে সপ্তাহখানেকের মধ্যে সরকারের কাছে একটি চিঠি লিখব।”
তিনি বলেন, “লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হল্টের জন্ম ১৬ ডিসেম্বর, বাংলার বিজয়ের দিনে। বিজয় দিবসে যার জন্ম, তার নাগরিকত্ব নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগেই সমাধান হবে বলে আশা করছি।”
১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশে বসবাস করছেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস; সক্রিয় আছেন বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সমর্থনে এবং পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে।
বাংলাদেশে পরিচিতজনদের কাছ থেকে ‘জুলিয়ান ভাই’ সম্বোধন শুনতেই ভালোবাসেন তিনি।
১৯৬৮ সাল থেকে বিহারে অক্সফামের একটা কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতেন ফ্রান্সিস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থী শিবিরে কাজ শুরু করে তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় অক্সফামের হয়ে শরণার্থী শিবিরের কাজের জন্য ২০১২ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সম্মাননা’ দেওয়া হয় জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে।
সে সময় পাকিস্তানিদের আক্রমণের ভারতের পালিয়ে যাওয়া প্রায় ছয় লাখ শরণার্থীকে সহায়তার কার্যক্রম সমন্বয় করেন এই ব্রিটিশ নাগরিক।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মনে করি, আমার নাগরিত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া সর্বশেষ পর্যায়ে আছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আমি আরও কিছু বিস্তারিত তথ্যও ইতোমধ্যে পাঠিয়েছি।
“এখানে অফিসিয়ালি কেউ নাগরিকত্ব পায় জন্মগ্রহণ করার কারণে, আবার কেউ কেউ পায় দেশে অনেক টাকা বিনিয়োগ করার কারণে। আরেকটি বিধান আছে, বিশেষ অবদানের জন্য কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়া হতে পারে।”
বিশেষ অবদানের জন্য নাগরিকত্বের স্বীকৃতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আসে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমিও এই বিধানের মধ্যে পড়ি, সরকারের কাছ থেকে ১৯৭১ সালের কাজের জন্য ‘বাংলাদেশের বন্ধু’ স্বীকৃতি পেয়েছি, দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করছি।
“এ অবস্থান থেকে আমি মনে করি, আমি নাগরিকত্ব পেতে পারি।”
এর আগে হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখন আমার ঘরের চেয়ে বেশি’।