ছায়েদুল হকের ভিটায় ভাঙা টিনের ঘর

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পৈত্রিক ভিটায় ভাঙা দুটি টিনের ঘর ছাড়া আর কোথাও কোনো বাড়ি নেই সদ্য প্রয়াত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী ছায়েদুল হকের, যাকে সৎ রাজনীতির ‘প্রতিভূ’ অভিহিত করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিপীযূষ কান্তি আচার্য, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Dec 2017, 06:00 PM
Updated : 17 Dec 2017, 06:16 PM

রোববার নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ গ্রামে ছায়েদুল হকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ভাঙাচোরা দুটি টিনের ঘর। চেহারা দেখেই বোঝা যায় দীর্ঘদিন মানুষের বসবাস নেই সেগুলোতে।

ছায়েদুল হক নাসিরনগর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মোট পাঁচবার। এরমধ্যে ১৯৯৬ সাল থেকে টানা চারবার এমপি তিনি। তখন থেকেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন।

এলাকায় গেলে তিনি উপজেলায় ডাকবাংলো এবং একজন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে থাকতেন। তার জীবনযাপন ছিল একদম সাদামাটা।

তাকে দেখে সাদামাটা জীবনযাপন শুরু করেন বলে জানিয়েছেন উপজেলার সিংহগ্রামের বাসিন্দা অনিন্দ দাস।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছায়েদুল হক একশত ভাগ সৎ ও নির্লোভ ছিলেন। নাসিরনগরে তিনি যখন আসতেন, তখন ডাকবাংলোতেই থাকতেন। আমরা মাঝে মাঝে দেখতাম তার গায়ে ছেড়া গেঞ্জি। তার এই সাদামাটা জীবন দেখে আমিও জীবনাচার বদল করছি।”

নাসিরনগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এটিএম মুনিরুজ্জামান সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া পূর্বভাগ গ্রামের দুটি টিনের ঘর ছাড়া ছায়েদুল হকের আর কিছুই নেই, তাও আবার ভাঙা।

“১৯৯৬ সালের পর থেকেই তিনি নাসিরনগর ডাকবাংলোতে থাকতেন। মাঝে মাঝে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির রাফি উদ্দিনের বাড়িতেও রাত্রিযাপন করতেন।”

মুহাম্মদ ছায়েদুল হক (১৯৪২-২০১৭)

ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছায়েদুল হক ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি নেওয়ার পর এলএলবি পাস করে আইন পেশায় নিজেকে যুক্ত করেছিলেন ছায়েদুল হক।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কাজ করে ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। ২০১৪ সালে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী হওয়ার পর মিন্টো রোডের সরকারি বাসায় ওঠেন তিনি।

ছায়েদুল হকের একমাত্র ছেলে এ এস এম রায়হানুল ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রভাষক।

৭৫ বছর বয়সী ছায়েদুল হক শনিবার সকালে মারা যান।

তার মৃত্যুর খবর শুনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির অনেক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ছুটে যান।

প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। এদেশে অনেকে ‘পাওয়ার’ পেলে তার অপব্যবহার করে, কিন্তু ‘পাওয়ার’ পেয়েও তাকে দুর্নীতি স্পর্শ করতে পারেনি। তার মতো সৎ মানুষ বিরল।”

ছায়েদুল হকের পাশের গ্রামের অর্জুন দাস বলেন, “নাসিরনগরে এমন নেতা আর হয়ত জন্ম নেবে না। তার সততা প্রশ্নাতীত। বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতি করা এই নেতার কাছে কোনো দুর্নীতিবাজের আশ্রয় ছিল না।”

বাবার ভিটায় এই ঘর থাকলেও ছায়েদুল হক সেখানে থাকেননি অনেক বছর, এলাকায় গেলে উপজেলায় ডাকবাংলো ও এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে রাত কাটত তার

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে ছায়েদুল হক প্রথম নির্বাচিত হন ১৯৭৩ সালে। এরপর ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর কাছে হেরে যান।

১৯৯৬ সালে আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন ছায়েদুল হক। এরপর আরও কখনও নির্বাচনে হারেননি তিনি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির রাফি উদ্দিন বলেন, “ছায়েদুল হক ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ। নির্বাচনে তার জয়লাভের পেছনে সব সময়ই কাজ করেছে নাসিরনগরের প্রায় ৪০ হাজার হিন্দু ভোটার।”

গত বছর নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ছায়েদুল হককে। তবে স্থানীয় হিন্দুরা ওই ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের দ্বন্দ্বকে দায়ী করেছিলেন, সে সময় মন্ত্রী ছায়েদুল হকের প্রশংসাও করেছিলেন কেউ কেউ।