বিচার নিয়ে শঙ্কায় নাসিরনগরের মানুষ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাটের পর আগুন দেওয়ার ঘটনার বছর পেরিয়ে গেলেও পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধিপীযূষ কান্তি আচার্য, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2017, 07:23 AM
Updated : 30 Oct 2017, 05:38 PM

স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বলেছেন, সময় যত গড়াচ্ছে, বিচার পাওয়া নিয়ে তাদের শঙ্কাও বাড়ছে।

অবশ্য জেলার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমানের ভাষ্য, ‘ন্যায়বিচারের স্বার্থেই’ তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে।

সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তাড়হুড়ো করে অভিযোগপত্র দিতে গেলে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হতে পারে। তাই ভাংচুরের ভিডিও পর্যালোচনা করে ধীর-স্থিরভাবে কাজ করছে পুলিশ। অপরাধীরা যে-ই হোক, কেউ রেহাই পাবে না।”

ফেইসবুকে ‘ইসলাম অবমাননার’ ছবি পোস্ট করার অভিযোগ তুলে গত বছর ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়ি-ঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাটের পাশাপাশি আগুন দেওয়া হয়। এরপর ৪ ও ১৩ নভেম্বর ভোরে আরও ছয়টি ঘরে আগুন দেওয়া হয়।

এসব ঘটনায় নাসিরনগর থানায় আটটি মামলা করে পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্তরা।

গত এক বছরে নাসিরনগরের পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় ভুগছেন স্থানীয় হিন্দুরা।

একটি অগ্নিসংযোগ মামলার বাদী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন দেব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক বছরেও মামলার কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় আমরা বিচার নিয়ে শঙ্কিত। দিন যত বাড়ছে আমাদের মনে শঙ্কাও বাড়ছে।

“সরকারের কাছে আমাদের দাবি, অবিলম্বে যেন হামলায় জড়িত সব আসামিকে বিচারের আওতায় আনা হয়।”

এক বছরেও বিচার শুরু করতে না পারা ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সভাপতি জয়দুল হোসেন।

তিনি বলেন, “হামলায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা না গেলে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত আসতে পারে।”

নাসিরনগরের বাসিন্দা অমল দাস, মনোরঞ্জন ঘোষ, বিনোদ চৌধুরীসহ ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই বলেছেন, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের পর তারা আবার ঘর তুলেছেন, কিন্তু ওই ঘটনা তাদের মনের জোর অনেকখানি কমিয়ে দিয়ে গেছে। 

কাশিপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত অমূল্য দাস বলেন, “সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় এখন কোনো রকমে জীবন কেটে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ক্ষত মন থেকে এখনও যায়নি। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মনে শান্তি আসবে না। মনের শঙ্কা যাবে না।”

ঘটনার শুরু রসরাজ দাস নামে এক মাছ বিক্রেতার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ছবি পোস্ট করার অভিযোগ নিয়ে।

ওই ছবিতে ইসলাম অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে নাসিরনগর থানায় করা এক মামলায় নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজকে গত বছর ২৯ অক্টোবর পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

পরদিন ৩০ অক্টোবর এলাকায় মাইকিং করে সমাবেশ ডাকা হয়। ওই সমাবেশের উসকানি থেকেই পরে নাসিরনগরের হিন্দুপল্লীতে হামলা চালায়। 

সেদিন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ডাকা একটি সমাবেশে ওসি কাদের ও ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জেম হোসেনও বক্তব্য রেখেছিলেন। বক্তব্যে উসকানির অভিযোগের মুখে ওসিকে প্রত্যাহারের পর ইউএনওকেও প্রত্যাহার করা হয়।

ওই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে নাসিরনগরের এমপি মৎস‌্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক এবং সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরীর সমর্থকদের কোন্দলও ভূমিকা রেখেছে বলে পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।

অনেক সমালোচনার পর হামলার ‘মূল হোতা’ হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

হামলার সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে গ্রেপ্তার করা হয় আরও ১২৩ জনকে, যাদের মধ্যে চাপরতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরুজ আলী, নসিরনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল আহাদ, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল হোসেন চকদারও ছিলেন।

এখন আঁখি ছাড়া সবাই জামিনে রয়েছেন। আর আড়াই মাস কারাভোগের পর রসরাজও জামিন পেয়েছেন।

রসরাজের আইনজীবী মো. নাছির মিয়া বলেন, “পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) দীর্ঘ তদন্ত শেষে নিশ্চিত হয়েছে, ওই বিতর্কিত ছবিটি রসরাজের ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়নি।”

অভিযোগ থেকে মুক্ত হলেও রসরাজ এখনও আতঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারেননি বলে জানান এই আইনজীবী।