ক্ষমতাসীনদের দ্বন্দ্বে সংঘাতময় হাতিয়া

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তঃকলহে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার রাজনীতির মাঠ ক্রমেই সংঘাতময় হয়ে উঠছে।

নোয়াখালী প্রতিনিধিআবু নাছের মঞ্জুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Sept 2017, 07:03 PM
Updated : 8 Sept 2017, 06:49 AM

গত ছয় মাসে যুবলীগের তিন নেতা নিহত হয়েছেন এই কোন্দলে। গত বুধবার বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাও ঘটে, যেখানে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌসের স্বামী মোহাম্মদ আলী এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক ওয়ালী উল্লাহর বিরোধেই এই সংঘাত।

আয়েশা সংসদ সদস্য হলেও মূলত প্রভাব তার স্বামী মোহাম্মদ আলীর, যিনি সাবেক সংসদ সদস্য।

জাতীয় পার্টি থেকে আসা মোহাম্মদ আলীকেই যুবলীগ নেতাদের হত্যার জন্য দায়ী করছেন সাবেক সংসদ সদস্য ওয়ালী উল্লাহ।

অন্যদিকে মোহাম্মদ আলীর অভিযোগ, ওয়ালী উল্লাহই এই সংঘাতে ইন্ধন দিচ্ছেন।

হাতিয়া দ্বীপে ক্ষমতাসীনদের এই সংঘাত জাতীয় রাজনীতিতেও আলোচনায় উঠে এসেছে।

বৃহস্পতিবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করতে গিয়ে হাতিয়াকে উদাহরণ হিসেবে টানেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

 

স্থানীয়রা জানায়, ওয়ালী উল্লাহ ও মোহাম্মদ আলী সমর্থকদের নতুন করে বিবাদ শুরু হয় গত ৩০ মার্চ হাতিয়া আফাজিয়া বাজারে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চালের জন্যে ডিলারের গুদাম ঘেরাওকে কেন্দ্র করে।

সেদিন একটি দোকানে বসে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদের ছোট ভাই হাতিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক আশরাফ উদ্দিন (৪০)। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নয় দিন পর তার মৃত্যু হয়।

চরঈশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য রবীন্দ্র কুমার দাসের নেতৃত্বে সেদিন গুলিবর্ষণ হয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয় মামলায়।

এরপর ১৩ এপ্রিল চরকিং ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য মনির উদ্দিনের বাড়িতে গুলি করে আশরাফ হত্যা মামলার কয়েকজন আসামি। তখন ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য নুরুল আলম (৩০) নিহত হন।

গত ৩০ অগাস্ট স্থানীয় সেকু মার্কেটে তাকে কুপিয়ে ও রগ কেটে হত্যা করা হয় সোনাদিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সদস্য রিয়াজ উদ্দিনকে (২৭)।

নিহতের বাবা কোরবান আলী বাদী হয়ে যে মামলা করেছেন, তাতে সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌসের স্বামী মোহাম্মদ আলীকেও আসামি করা হয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওয়ালী উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোহাম্মদ আলীর লোকজন গত ছয় মাসে যুবলীগের তিনজন নেতাকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। আহত করেছে শতাধিক নেতাকর্মীকে। যাদের অনেকেই এখন পঙ্গু হয়ে আছেন।”

বুধবারের সংঘাতে আহত কয়েকজন

অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী বলেন, “ওয়ালী উল্লাহর অনুসারীরা আমাকে ও আমার লোকজনকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়াচ্ছে।”

বুধবার সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌসের সভায় হামলা চালিয়ে চার জন কর্মীকে ওয়ালী উল্লাহ সমর্থকরা আহত করেন বলেও মোহাম্মদ আলীর দাবি।

অন্যদিকে ওয়ালী উল্লাহর দাবি, সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌসের মদদে আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদ আলী রাতুলের বাসায় হামলা ও গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ১১ জন গুরুতর আহত হন।

গত বুধবার দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলায় আহতদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ পাঁচজনকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা হলেন- নাজিম উদ্দিন (২৫), সাঈদ উদ্দিন (২৬), মাইন উদ্দিন (২৫), আবদুর রহমান (২২) ও আরিফুল ইসলাম সজিব (৩২)। এরা সবাই ওয়ালী উল্লাহর পক্ষের।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আহতদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে শটগানের বুলেট বিদ্ধ হয়েছে। মাইন উদ্দিন ও সাঈদ উদ্দিনের গলায় গুলিবিদ্ধ হওয়ায় তাদের দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

মাইন উদ্দিন, সাঈদ উদ্দিন ও নাজিম উদ্দিনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

অস্ত্র হাতে সংঘর্ষে

সেদিন সংঘর্ষের সময় আওয়ামী লীগ নেতা রাতুলের বাড়িতে হামলাকারীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। তারা মোহাম্মদ আলীর সমর্থক বলে অন্য পক্ষের দাবি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “আয়েশা ফেরদৌসের উপস্থিতিতে মোহাম্মদ আলীর অনুসারীরা রাতুলের বাসায় হামলা চালিয়ে ১১জন নেতা-কর্মীকে গুলিবিদ্ধ করে। হামলাকারীরা ওই বাসার চেয়ার টেবিল ও জানালার গ্লাসও ভাংচুর করে।”

পাল্টা অভিযোগে মোহম্মদ আলী বলেন, তাকে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর প্রতিবাদে তার বাসায় সভা চলাকালে ওয়ালী উল্লাহ সমর্থকরা হামলা চালালে তার পক্ষের জারজন আহত হন।

হাতিয়া থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, “সংঘাতের খবর শুনে ফাঁকা গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ।”

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বুধবারের ঘটনায় হাতিয়া থানার এসআই সফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও আড়াইশ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

এছাড়া আগের সব ঘটনার মামলার আসামিদের ধরার বিষয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে  বলে দাবি করেন তিনি; যদিও ওয়ালী উল্লাহর সমর্থকদের এনিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

ইউপি চেয়ারম্যান আজাদ আটক

চেয়ারম্যান আবদুল হালিম আজাদ

সংঘাতের মামলায় চর ঈশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম আজাদকে বৃহস্পতিবার আটক করেছে কোস্টগার্ড। তিনি ওয়ালী উল্লাহর অনুসারী।

বাহিনীর হাতিয়া স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট বোরহান জানান, বিকেলে টাংকির খাল এলাকা থেকে আজাদসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়।

হাতিয়া থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, আজাদ বুধবারের সংঘর্ষের মামলার প্রধান আসামি। তার বিরুদ্ধে আরও ২০টির মতো মামলা রয়েছে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন দাবি করেন, রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে আজাদকে আসামি করিয়েছেন মোহাম্মদ আলী।