‘জীবন বাঁচানোই বড় ঈদ’

রাখাইনের কিরণছড়ির রাশেদা বেগমের কাছে কিছুদিন আগেও ঈদ মানে ছিল আনন্দের দিন; এবার কোরবানির ঈদের দিনটি তার কেটেছে ভিনদেশে মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজার চেষ্টায়।

কক্সবাজার প্রতিনিধিশংকর বড়ুয়া রুমি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Sept 2017, 07:14 PM
Updated : 3 Sept 2017, 07:36 PM

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, গত এক সপ্তাহে ৬০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পঞ্চাশোর্ধ রাশেদা তাদেরই একজন।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার তৈজমাঘোনার পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গা নারী শনিবার ঈদের দিন বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মিয়ানমারে প্রতিবছর ধুমধাম করেই কোরবানির ঈদ করতেন তারা। কিন্তু এ বছর তা কপালে জোটনি।

“জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছি, সেটাই আজকে আমাদের কাছে বড় ঈদ।”

 

রাশেদার মত হাজারো রোহিঙ্গা নারী পুরুষ শিশু এখন কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয়ের খোঁজে ব্যস্ত। তাদের একটি অংশ উঠেছেন কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী শিবিরে। যাদের সেখানে ঠাঁই হয়নি, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দুপাশ এবং পাহাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় তারা গড়ে তুলছেন অসংখ্য ঝুপড়ি ঘর।

কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের দক্ষিণাংশ থেকে শুরু করে পালংখালী স্টেশন পর্যন্ত অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই ঝুপড়ি তৈরির হিড়িক দেখা গেছে শনি ও রোববার । বাঁশের খুঁটিতে পলিথিন বা কাপড় টানিয়ে তৈরি এসব ঝুপড়িতে কোনো রকমে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হচ্ছে তাদের।

টেকনাফের সীমান্তবর্তী হোয়াইক্যং ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও দেখা গেছে পাহাড়ের মাটি কেটে সারি সারি ঝুপড়ি তৈরির দৃশ্য।

ছবি: রয়টার্স

ছবি: রয়টার্স

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের থাইংখালীর পাহাড়ি এলাকায় ঝুপড়ি তুলেছেন মিয়ানমারের মংডুর বলিবাজার এলাকা থেকে আসা মোহাম্মদ হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হোসেন বলেন, তার চোখের সামনে তিন সন্তানকে গুলি করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কোনো রকম জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছেন।

সীমান্ত পেরিয়ে এসে গত কয়েক দিন তার কেটেছে অনাহারে-অর্ধাহারে। ঈদ কোথায়! এখন তার চিন্তায় শুধু দুমুঠো অন্ন, আর  মাথা গোঁজার ঠাঁই।

হোসেন জানান, পরিবারের আট সদস্য নিয়ে উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী ও টেকনাফের লেদার শরণার্থী ক্যাম্পে জায়গা না পেয়ে থাইংখালীর পাহাড়ে এসেছেন তিনি।

“একজন অপরিচিত লোক কয়েকটি বাঁশ ও একটি বড় পলিথিন দিয়েছে। তাই দিয়ে ছাউনি দিয়েছি। কিন্তু হাতে টাকা-পয়সা নেই। পরিবারের সবাই গত তিন দিন ধরে অনাহারে-অর্ধাহারে আছে।”

ছবি: রয়টার্স

একই দুর্দশার কথা জানালেন উখিয়ার থাইংখালী ও বালুখালী পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ফকিরাবাজার থেকে আসা আব্দুল হাকিম ও সাহেব বাজারের সালাহউদ্দিন।

আব্দুল করিম বলেন, মিয়ামারের পাহাড় আর জঙ্গলে চার-পাঁচ দিন লুকিয়ে থাকার সময় অন্য কিছু না পেয়ে কলাগাছ খেয়ে খিদে মিটিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশে ঢোকার পর এক অচেনা লোক কিছু কলা-বিস্কুট দিয়েছিলেন। এরপর আর খাবার জোটেনি। কোথাও জায়গা না পেয়ে থাইংখালী পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।

নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা কুতুপালং ও বালুখালী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেয়েছেন, তাদের অনেকে শনিবার ঈদের নামাজেও অংশ নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও সেই ছবি প্রকাশিত হয়েছে।

ছবি: রয়টার্স

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ২৪ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে পুলিশ পোস্ট ও সেনাক্যাম্পে হামলার পর থেকেই বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল চলছে। দিনের বেলায় সীমান্ত কিছুটা শান্ত থাকলেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই স্রোতের মত প্রবেশ করতে থাকে রোহিঙ্গারা।

এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে স্বজন হারিয়েছেন। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি। সহায়-সম্পদ ফেলে কোনো রকমে প্রাণ হাতে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন তারা। 

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আলমগীর ফরহাদ বলছেন, রোহিঙ্গারা প্রতিদিনই আসছে। তবে ব্যাপকহারে অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে।

পালংখালীর বালুরচর, বালুখালী, বাঘঘোনা ও আঞ্জুমান পাড়ার পাহাড়ি এলাকায় যে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের সংখ্যা ৫০ হাজারের কম নয় বলে তার ধারণা।

ফরহাদ বলেন, “সীমান্তের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় যত্রতত্র আশ্রয় নেওয়ায় অনেকটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে এসব রোহিঙ্গা। এতে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”

বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়া এই রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি করে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে আশ্রয় দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অমানবিক পরিস্থিতিতে পড়া মিয়ানমারের এই নাগরিকদের যতটা সম্ভব সাহায্য করছেন কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল তৎপর না হলে বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা আরও বড় হয়ে উঠবে।

পালংখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, তার ইউনিয়নের পাঁচটি পাহাড়ি এলাকায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণণের বাইরে পাহাড়ি এলাকায় বসতি গড়ে তুলছে তারা।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, রোহিঙ্গারা পাহাড়ের বিশাল এলাকাজুড়ে বসতি গড়ে তুললেও প্রশাসনের তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। 

এ ব্যাপারে কথা বলতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন ও উখিয়ার ইউএনও মো. মাঈনুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন ধরেননি।

আরও পড়ুন