‘ব্যাপক তাণ্ডব চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা, নির্যাতন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপক তাণ্ডব চালাচ্ছে বলে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা জানিয়েছেন।

কক্সবাজার প্রতিনিধিশংকর বড়ুয়া রুমি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2017, 11:50 AM
Updated : 2 Sept 2017, 11:50 AM

গত ২৫ অগাস্ট রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনা চৌকিতে হামলার পর থেকে সেনাবাহিনী অভিযানে নামে।

সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ এবং বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসতে শুরু করে।

রোহিঙ্গারা ব্যাপক হারে এদেশে প্রবেশ করছে বলে স্থানীয়রা বললেও বিজিবি বলছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবি সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) হিসাব মতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৫৮ হাজার ৬০০ রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে।      

টেকনাফের লম্বাবিল এলাকায় একটি মাদ্রাসায় অবস্থান নেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আকিয়াব জেলার মংডুর বালুখালীর বাসিন্দা হালিমা খাতুন (৫৫)।

সরেজমিন গিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে হালিমার সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধির সঙ্গে।

হালিমা বলেন,“মিয়ানমারে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের উপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে হত্যার পাশাপাশি পুড়িয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা। সহায়-সম্পদ লুটপাটের পাশাপাশি জবাই করে হত্যার ঘটনাও ঘটছে।

“গত ২৭ অগাস্ট দিনের বেলায় সেনাবাহিনী বালুখালী গ্রামে ঢুকে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এতে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে এবং ১০/১২ জনকে ধরে নিয়ে যায়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ২০টি বাড়ি।”

এ সময় গ্রামের লোকজন প্রাণ বাঁচাতে দিকবিদিক পালাতে থাকে।

এরপর ৪/৫ দিন বিভিন্ন বন-জঙ্গলে অনাহারে থেকে বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফের লম্বাবিলের এই মাদ্রাসায় আশ্রয় নেন বলে জানান হালিমা।

পালিয়ে আসা আরেকজন হলেন একই এলাকার (মংডুর বালুখালীর) ষাটোর্ধ্ব আব্দুস শুক্কুর।

তিনি বলেন, “বালুখালী গ্রামে হামলার দিন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমার দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে। বাড়িতে লুটপাট চালানোর পর পেট্টোল ঢেলে পুড়িয়ে ধরিয়ে দেয়।”

প্রাণ বাঁচাতে স্ত্রী, ছেলেদের বউ ও নাতি-নাতনিসহ ১২ জন তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন বলে জানান শুক্কুর।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ওমর ফারুক (৫৮) বলেন, “রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে প্রতিদিনই চলছে তাণ্ডব। গত এক সপ্তাহে মিয়ানমারের মংডুর বালুখালী এলাকাসহ আশপাশের সাতটি গ্রামে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাণ্ডব চালিয়েছে।”

এলাকাবাসী জানান, প্রথমদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করলেও টেকনাফ সীমান্ত অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। বৃস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে টেকনাফের নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়েও আসতে থাকে রোহিঙ্গারা।  

সরেজমিন টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় দেখা গেছে, কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়া উপজেলার পালংখালী স্টেশন, থাইংখালী স্টেশন এবং টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী, ঝিমংখালী, লম্বাবিল, উলুবনিয়া ও উনচিপ্রাং এলাকার অন্তত পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে শত শত অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের অবস্থান।

কিছুদূর পর পর চোখে পড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলা রোহিঙ্গাদের দল। কোনো দলে অর্ধশত, কোনটিতে একশর মতো রোহিঙ্গা রয়েছেন।

এদের কেউ কেউ সড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন গাড়ি করে যাচ্ছিলেন উখিয়ার কুতুপালং এবং বালুখালী এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের দিকে।

অনুপ্রবেশকারীদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। কারও কোলে শিশু, কারও মাথায় বেঝাই করা শেষ সহায়-সম্বল, কেউবা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন গরুসহ বিভিন্ন গবাদি পশু।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে এসব রোহিঙ্গা প্রথমে আশ্রয় নেন উখিয়ার পালংখালী এবং টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুলসহ বিভিন্ন জায়গায়।

আশ্রয়ের সন্ধানে বিভিন্ন থানে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে খাবার বিতরণ করতে দেখা গেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল এলাকার বাসিন্দা আব্দুস সালাম (৬০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নামার পরপরই ইউনিয়নের লম্বাবিল, কাঞ্জরপাড়া, ঝিমংখালী ও খারাংখালীসহ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট অতিক্রম করে দলে দলে রোহিঙ্গারা আসতে থাকে। তারা এপারে আসার পর স্থানীয় মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়।

“লম্বাবিল মাদ্রাসায় অন্তত ১৫ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।”

এদের মাঝে স্থানীয়রা সাধ্যমতো ভাতসহ বিভিন্ন ধরনের শুকনো খাবার বিতরণ করেছেন বলে জানান তিনি।

শুক্রবার গভীর রাতে লম্বাবিল মাদ্রাসার কর্মচারী হাফেজ ছালামত উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাদ্রাসাটির মসজিদ, শ্রেণিকক্ষ ও বারান্দাসহ সবখানেই ঠাসাঠাসি করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান নিয়েছে।

“তাদের মুখে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনি শুনেছি।”

ছালামত উল্লাহ বলেন, এদের অনেকে আবার রাতেই হেঁটে কিংবা গাড়ি করে পাশের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয়ের আশায় চলে যান বলে জানান তিনি।

একটি দল চলে গেলেও নতুন আসা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান ছালামত।  

উখয়ার পালংখালীর বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক মোহাম্মদ উল্লাহ বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে কুতুপালং ও বালুখালীর রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয়ের জন্য দলে দলে রোহিঙ্গাদের যেতে দেখেছেন।

“গত এক রাতেই অন্তত ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে শরণার্থী ক্যাম্পের দিকে যেতে গেছে।”

এখনও থেমে থেমে রোহিঙ্গারা আশ্রয়ের জন্য ছুটছেন বলে জানান তিনি।

বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নের মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবির সদস্যরা কড়া সতর্ক অবস্থায় রয়েছেন। কোনোভাবেই যেন রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য টহল জোরদারের পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে অতিরিক্ত ফোর্সও।

ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, “সীমান্তে কিছু দুর্গম পয়েন্ট রয়েছে। এতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দ্রুত যাতায়াত করা দুস্কর হয়ে পড়ে। এক শ্রেণির দালাল অনুপ্রবেশে সহায়তা করছে।

তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

একই ধরনের কথা বলেন বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম।

সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের কড়া নজরদারির কথা উল্লেখ করে কর্নেল আরিফুল বলেন, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর থেকে সাম্প্রতিক সময়ে বৃহস্পতিবারই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা ‘অনুপ্রবেশ চেষ্টার’ ঘটনা ঘটেছে।

“বিজিবি বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে দিনভর সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টের শূন্যরেখা অতিক্রম করে অনুপ্রবেশের সময় চার হাজার ৫৩৮ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে।” 

এদিকে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনার বিষয়টি তিনি শুনেছেন।  

তবে ঠিক কত সংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।