কুড়িগ্রামে ঈদ আনন্দ ভেসেছে বানের জলে

প্রবল বন্যায় কুড়িগ্রামে এবার ঈদ আনন্দ নেই বললেই চলে। বাড়িঘর, ফসল, সহায় সম্বল হারিয়ে মানুষ দিশেহারা। অনেকেই এখনও খোলা জায়গায় বাস করছেন। বন্যার ধকল সামলাতেই ব্যস্ত তারা।

আহসান হাবীব নীলু কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2017, 07:02 AM
Updated : 31 August 2017, 07:02 AM

“যা সুখ শান্তি সোউগ বানের পানিত ভাসি গেইছে। বাড়ি-ঘর, আসন-বাসন যাকিছু কষ্ট করি করচি সোউগ গেইছে। এ্যালা কিসের ঈদ, কিসের তাওয়া। আল্লায় সুখ দেয় নাই, কী দিবে বান্দায়?”

বিলাপ করতে করতে বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার জগমোহনের চরের সুরতভান বেওয়া। বন্যায় বাড়িঘর ভেঙে তার সহায় সম্বলহীন পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে খোলা জায়গায় তাঁবুর নীচে।

সরকারি হিসাবে জানা যায়, এ বছর কুড়িগ্রামের নয়টি উপজেলার এক লাখেরও বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ভিটেবাড়ি হারিয়ে সম্বলহীন হয়েছে দশ হাজারের বেশি পরিবার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উলিপুর, কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলায়।

দ্বিতীয় দফা বন্যায় সহায় সম্বল হারিয়ে সীমাহীন কষ্টে দিন কাটছে সদর উপজেলার জগমোহনের চর ও নন্দদুলালের ভিটা গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবারের।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস পাওয়া তথ্যে জানা যায়, জেলার নয়টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ৮২০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুই হাজার ৫১ মেট্রিকটন চাল ও ৭৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা এবং ছয় হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এ পর্যন্ত সরকারিভাবে বিতরণ করা হয়েছে।

জগমোহনের চরে সরেজমিনে দেখা গেছে, আকস্মিক বন্যায় ঘর-দুয়ার, ধান-চাল, জামা-কাপড়, হাঁস-মুরগীসহ সবকিছু বানের জলে ভেসে গেছে। ঘরে খাবার নেই। কোরবানি দেওয়া সামর্থ্যবান অনেকের জন্যও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ১২ অগাস্ট থেকে বাঁধের রাস্তায় খোলা স্থানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন জগমোহনের চরের ছফর আলী ও ওসমান আলী।

তারা বলেন, তাদের ঘরে খাবার নেই। হাতে কাজ নেই। জামা-কাপড় সব ভেসে গেছে বন্যায়। সন্তানদের সাধ-আহ্লাদ পূরণের কোনো সামর্থ্য নেই তাদের। তাই এবার ঈদ কাটবে আর দশদিনের মতো।

সব হারানো নন্দদুলালের ভিটা গ্রামের শাহিদা আক্তার কেবলই কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, “আল্লাহ হামাক গুলাক বাঁচাও’।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী-কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদীতে প্রায় চার শতাধিক চরে আড়াই লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। এ বছর বন্যায় জেলার নয়টি উপজেলার এক লাখ ২৬ হাজার ৬১৬টি ঘরবাড়ি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এর মধ্যে নদী ভাঙ্গনে ভিটেবাড়ি হারিয়েছে ১০ হাজার ৬১২টি পরিবার; মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের।

সেতু ভেঙ্গে গেছে ২৩টি। পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ দশমিক ৬২ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। গ্রামীণ এবং আন্তঃউপজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের বাবর আলী (৬০) বলেন, “আমার চার একর জমির আমন ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় দুই সপ্তাহ স্থায়ী বন্যায় ঘরে রাখা চাল, ধানসহ মূল্যবান অনেক সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। ভেসে গেছে পুকুরের লক্ষাধিক টাকার মাছ।”

এমন অবস্থায় চার সন্তান নিয়ে চরম কষ্টে দিন পার করছেন। তাই প্রতিবছর কোরবানি দিলেও এবছর তা সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি।

একই ইউনিয়নের গাবুরজান গ্রামের অছিমুদ্দিন (৬৫) বলেন, বন্যায় তার আট একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর বাড়ি মেরামত ও নতুন করে ফসল লাগানোর কাজ করছেন। এতে অনেক টাকা লাগছে। তাই কোরবানি দেওয়া সম্ভব হবে না এবার।

সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান বলেন, বন্যায় তার ইউনিয়নে পানিবন্দি হয় ৩২ হাজার মানুষ। ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ৪০৫ জনের। ২৯০টি বাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে।

অথচ এ পর্যন্ত সরকারি মাত্র ৫৯ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম বলে জানান তিনি।

চেয়ারম্যান সাইদুর বলেন, এসব মানুষের পক্ষে আনন্দের সঙ্গে ঈদ করা কষ্টকর হবে। এমনকি অবস্থাসম্পন্ন অনেকের পক্ষে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হবে না। বন্যার এ ধকল কাটিয়ে উঠতে কয়েক মাস সময় লাগবে ।