এবারের বন্যায় এ উপজেলার প্রায় পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পাওয়া গেছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ অসংখ্য মানুষের নিঃস্ব হওয়ার খবর।
চরগোরক মণ্ডল গ্রামের ৬০ বছর বয়সী আবু হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন কিভাবে তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যে হারিয়েছেন তার ৪০ বছর ধরে গড়ে তোলা বাড়িঘর।
“শনিবার শেষ বিকেল। বিছানায় গা এলিয়ে একটু আরাম করছিলাম। ঘুমের ভাব এসে গেছিল। হঠাৎ কোলাহল। ওয়াপদার রাস্তায় গিয়ে দেখি পানি তেড়ে আসছে। ফিরে গেলাম ঘরে। কিছুক্ষণ পর বিকট শব্দ। গাছগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। পরে দেখি পানি আর পানি। চোখের সামনেই মসজিদ ও আবুল হোসেনের বাড়ি বিকট শব্দে পড়ে গেল পানিতে।”
গোরক মণ্ডলে ধরলার বাঁধভাঙা পানি তেড়ে আসছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারলেও কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারি নাই। প্রবল স্রোতে ভেসে গেল মোর সংসার। কিভাবে যে বেঁচে আছি ভাবলে অবাক লাগে। গত ছয় দিনে কেউ খোঁজ নিল না।”
কথা বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন আবু হোসেন। একপর্যায়ে তিনি আহাজারি শুরু করেন। তারপর বিড়বিড় করে বলেন, “কাদা-পানি মোর সংসারকে খায়আ ফেলাইল। ৪০ বছর সাধনা করি একনা একনা সংসার বাঁধিনু। তাও নিমেষেই শেষ করি দিলু।”
একই কথা বললেন ওই গ্রামের দুলাল হোসেন (৫০), মামুদসহ (৪০) অনেকে।
চরবড়লই গ্রামের আব্দুল খালেক বললেন, “পানির তোড়ে ফুলবাড়ি থেকে কুড়িগ্রাম যাওয়ার একমাত্র পাকা রাস্তাটা চোখের পলকে ছিঁড়ে গেল। গ্রামের আঁধাপাকা বাড়িঘর চুরমার হয়ে গেল। অনেক বাড়িঘরের কোনো নিশানাও নেই। চর-বড়লই গ্রামটি এখন নদী হয়ে গেছে। কোনো কিছু রক্ষা করা যায়নি।”
গ্রামের শওকত আলী মুন্সী, মহাম্মদ আলী, হাবিবুর রহমান, আক্কাস আলী, মালেক, বিধবা খোদেজা বেওয়াসহ অনেকেই এ রকম বর্ণনা দিলেন।
প্রাণকৃঞ্চের ওয়াপদা বাঁধে আশ্রিত সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ইছাহক আলী বন্যার ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “এমন বান হবে ভাবি নাই। দুই মিনিটে ঘরত গলাপানি উঠিছে।”
তাদের ঠিকানা এখন রাস্তার খোলা আকাশ। তাদের চোখেমুখে এখনও আতঙ্ক। মাঝেমধ্যে ত্রাণ মেলে, কিন্তু তা দিয়ে একবেলাও চলে না বলে তারা জানান।
সরেজমিনে পচুটারি, ছয় বোনের চর, হাজিটারি, ফকিরের চর, বাংলা বাজার, হাজির মোড়, লম্বা গ্রাম, গোরকমণ্ডল আবাসন গ্রাম, কলির চর, শাহার চর, কেরকেরার চর ও খোকার চর ঘুরে সহস্রাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখা গেছে। মানুষজন আশ্রয় নিয়েছে ওয়াপদা বাঁধ ও বড় রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে।
পশ্চিম ধনিরামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোজাম্মেল হক বলেন, “ত্রাণ তো দূরে, আজ পর্যন্ত কেউ আমাদের কোনো খোঁজ নেয়নি।”
ওই গ্রামের সামাদ, মকবুল, বিঞ্চু, মুকুল, স্বাধীন চন্দ্র, ইদ্রিসসহ অনেকেই একই কথা জানালেন।
বৃদ্ধ ছফুর বলেন, “ব্যাহে, হামরাগুলা গরিব মানুষ মরি গ্যাইলেও সাহায্য পাবার নই। চেয়ারম্যান-মেম্বার খোঁজ নেয় না।”
দেখা গেছে, মাঝে মাঝে সূর্যের আলো ফুটলেই তারা বন্যায় ভেজা ধান-চাল রোদে শুকাচ্ছেন।
ধনিরামের সিরাজুল ও আল্পনা বললেন, ধান ভিজে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কী খাবেন তা নিয়ে দুশ্চিতায় রয়েছেন।
খাবার কেনার সামর্থ্য নেই কর্মহীন দিনমজুর পরিবারগুলোর।
প্রাণকৃঞ্চের কুঠিবাড়ি মডার্ন উচ্চবিদ্যালয়ের কাগজপত্র দেখা গেল পানিতে। পথে পথে সেতু, পাকা রাস্তা ভেঙে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
শাহবাজারে ভিক্ষা করে জীবিকা চালান বৃদ্ধ জমিলা খাতুন। তিনি বলেন, “হামার খোঁজ কায় রাখে ব্যাহে। হামরা তো ফকির মানুষ।”
ওই এলাকার স্কুলছাত্রী খুশি খাতুনের অভিযোগ, পচা ও দুর্গন্ধে বাঁধের দুই পাশের পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
ত্রাণসাহায্য বিষয়ে বড়ভিটা ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য খৈমুদ্দিন বলেন, “আমি বানভাসী ৪০ জনের জন্য ১০ কেজি করে চাল পাইছি। কিন্তু দেব কাকে? আমার এলাকায় শত শত লোক ক্ষতিগ্রস্ত। বিপদে আছি।”
এ ইউনিয়নে আট হাজার পরিবার চরম ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানালেন চেয়ারম্যান খয়বর আলী।
“এখনও অনেক পরিবার পানিবন্দি। সেখানে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র সাড়ে ১০ টন চাল। এটা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।”
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবেন্দ্রনাথ উরাঁও জানিয়েছেন, পানি কমতে শুরু করায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বানভাসী মানুষজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।
“দুর্গতদের খাওয়ানোর জন্য উপজেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় খিচুড়ি রান্না ও বিতরণ কার্যক্রম চলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।”
উপজেলায় এ পর্যন্ত ৪৯ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আর ভেঙেপড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।