বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেওয়া সেই দুর্ঘটনার ছয় বছর পর মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর বুধবার আসামির উপস্থিতিতে এই রায় ঘোষণা করেন।
বাসচালক জামিরকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় বেপরোয়া চালনার কারণে অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য (পরিকল্পিত নরহত্যা নয়) দোষী সাব্যস্ত করে আদালত তাকে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে।
পাশাপাশি তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে বলে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আফছারুল ইসলাম মনি জানান।
এছাড়া দণ্ডবিধির ৪২৭ ধারায় জামিরকে তার ‘দুষ্কর্মের’ জন্য ক্ষয়ক্ষতির কারণে দুই বছরের কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের সাজার আদেশ দিয়েছে আদালত।
তিনি বলেন, “এই মামলাটি অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর। সড়ক দুর্ঘটনার কোনো মামলায় সাজার এমন রায় আগে হয়েছে কি-না, তা আমার জানা নেই।”
আসামিপক্ষের আইনজীবী মাধব সাহা রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। আমার মক্কেল ন্যায়বিচার পাননি। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।
অন্যদিকে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মনি বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছে। আসামিপক্ষ আপিল করলে উচ্চআদালতে এই রায় বহাল থাকবে বলে আমার প্রত্যাশা।”
২০১১ সালের ১৩ অগাস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাস আরোহী তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল এবং মাইক্রোবাসের চালক মুস্তাফিজও নিহত হন ওই দুর্ঘটনায়।
আহত হন ওই মাইক্রোবাসে থাকা তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চিত্রশিল্পী ঢালী আল-মামুন ও তার স্ত্রী দিলারা বেগম জলি এবং তারেকের প্রোডাকশন ইউনিটের সহকারী সাইদুল ইসলামও।
সড়ক দুর্ঘটনায় দুই ব্যক্তিসহ পাঁচজনের মৃত্যুর ওই ঘটনা পুরো দেশকে নাড়া দিয়ে যায়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া।
দুর্ঘটনার দুই দিন পর মেহেরপুরের গাংনী থেকে জামির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে সময় জামির সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেন, মাইক্রোবাস চালকের দোষেই ওই দুর্ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঘটনায় দুই চালকেরই গাফিলতি ছিল।
ওই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরু করে আদালত। ২০১১ সালের শেষ দিকে জামিনে মুক্তি পান জামির।
রাষ্ট্রপক্ষে তিন পুলিশ সদস্যসহ মোট ২৪ জনের সাক্ষ্য ও জেরার পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়। ওইদিনই বিচারক রায়ের জন্য ২২ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন।
ক্যামেরার পেছনে কাজ করে যে বাংলাদেশিরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আশফাক মুনীর মিশুক ছিলেন অন্যতম। বাংলাদেশের ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যম যে কুশলীদের হাত ধরে নতুন যুগে পা রেখেছে, তাদের একজন তিনি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিবিসির ভিডিওগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এই সাবেক শিক্ষক মিশুক মুনীর নামেই পরিচিত।
বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তিমালিকানাধীন টেরিস্ট্রেরিয়াল টেলিভিশন একুশে টিভিতে হেড অব নিউজ অপারেশনস হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মিশুক মুনীর কানাডার রিয়েল টেলিভিশন, চ্যানেল ফোর ও সিবিসিতেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
২০১১ সালে ওই দুর্ঘটনার আগের বছর তিনি যোগ দেন এটিএন নিউজে। সেখানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব নেন।
তারেক মাসুদের সিনেমা রানওয়ের প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছিলে মিশুক মুনীর। এছাড়া ‘রিটার্ন টু কান্দাহার’, ‘ওয়ার্ডস অব ফ্রিডম’ প্রামাণ্যচিত্রগুলোতেও তিনি ছিলেন ক্যামেরার পেছনে।
তার চিত্রগ্রহণের প্রামাণ্যচিত্র টোকাই (১৯৮৬) ওবার হাউজেন ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে এবং রিটার্ন টু কান্দাহার (২০০৩) কানাডার এম্মি জোমিনি অ্যাওয়ার্ডে পুরস্কৃত হয়।
১৯৫৯ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করা মিশুক মুনীরের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। একাত্তরে পাকিস্তানি ঘাতকেরা যখন মুনীর চৌধুরীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়, ১২ বছর বয়সী মিশুক ছিলেন তার প্রত্যক্ষদর্শী। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল গঠনের পর সেখানে এক মামলায় সাক্ষী হিসেবেও তার নাম অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে যিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তিনি মাটির ময়নার পরিচালক তারেক মাসুদ। জাতীয় আত্মপরিচয়, লোকজ ধর্ম ও সংস্কৃতি তার সিনেমায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
১৯৫৬ সালে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় জন্মগ্রহণ করা তারেকের শিক্ষাজীবনের শুরুটা ছিল মাদ্রাসায়। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি।
১৯৮৯ সালে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে ‘আদম সুরত’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ১৯৯৫ সালে তার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র মুক্তির গান ও মুক্তির কথা (১৯৯৬) প্রশংসিত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।
এরপর ২০০২ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মাটির ময়না তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড পায়। স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ ছিলেন এই চলচ্চিত্রের সহ পরিচালক।
নিজেদের প্রোডাকশন হাউজ অডিও-ভিশন থেকে এরপর অন্তর্যাত্রা (২০০৬) ও রানওয়ে (২০১০) নামে আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মাসুদ ও ক্যাথরিন।
১৯৪৭ এর দেশভাগ নিয়ে ‘কাগজের ফুল’ নামে আরেকটি সিনেমা বানানোর কাজে হাত দেওয়ার পরপরই ২০১১ সালের অগাস্টে সেই দুর্ঘটনা ঘটে।