নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাইনুল ইসলাম ওরফে মুসা একযুগ আগে ‘বাংলা ভাই’ খ্যাত সিদ্দিকুল ইসলামের হাত ধরে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
Published : 28 Dec 2016, 12:56 PM
গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি নামে জঙ্গি সংগঠন গড়ে তুলে বাংলা ভাই ২০০৪ সালের এপ্রিলে রাজশাহীর বাগমারা, নওগাঁর আত্রাই, রাণীনগর ও নাটোরের নলডাঙ্গার বিস্তৃত অঞ্চলে ত্রাস ছড়ানো শুরু করে।
ওই সময় তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে মাইনুল জেএমজেবির সঙ্গে জড়ালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে পড়েননি।
বাগমারা উপজেলার গণিপুর ইউনিয়নের বজ্রকোলা গ্রামের মসজিদের সদ্যপ্রয়াত মুয়াজ্জিন আবুল কালাম মোল্লার ছেলে মাইনুল ইসলাম।
ওই গ্রামের মঞ্জুরুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই আমলেও মাইনুল জেএমবির সঙ্গে জড়িত ছিল। তার সঙ্গে বাড়িতে কিছু কিছু অপরিচিত লোকজন আসতো। তারা দু/তিন দিন থাকলেও বাড়ির বাইরে বের হতো না। তাই কিছু বোঝা যেত না।”
এলাকাবাসীরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শুরু হলে সিদ্দিকুল ইসলামের মতো মাইনুলও আত্মগোপনে চলে যান। কিছুদিন পর বেরিয়ে এসে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। সেখান থেকে ঢাকা কলেজে পড়াশোনা শেষে উত্তরার একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
চলতি বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতে ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত নব্য জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলামের মেয়ে এই স্কুলেই পড়ত।
জাহিদুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণেই নব্য জেএমবিতে মুসা নাম ধারণকারী মাইনুল উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে থাকা শুরু করেন বলে তার মা সুফিয়া বেগম জানান।
তিনি বলেন, উত্তরার যে বাসার ছয় তলায় মুসা স্ত্রী তৃষা মনি ওরফে উম্মে আয়শাকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন, সেখানকার দোতলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন মেজর জাহিদ।
“মুসার সঙ্গে মেজর জাহিদের ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল। মাঝে মধ্যে কিছু লোকজনও আসতো ওই বাড়িতে। ছাদে তারা মিটিং করত; কী মিটিং তখন বুঝিনি। এখন বুঝি, আসলে তারা জঙ্গির মিটিং করত,” বলেন সুফিয়া।
সর্বশেষ আট মাস আগে মুসা বজ্রকোলার বাড়িতে গিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “বাড়িতে থাকা তার ছবিসহ বেশ কিছু কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে। পরে সৌদি আরব যাবে বলে ৩ লাখ টাকার জমি বিক্রি করে বাড়ি থেকে চলে যায়। এরপর কোনো যোগাযোগ রাখেনি।”
টেলিভিশনের খবরে ছেলের ‘জঙ্গি’ হওয়ার কথা জানতে পেরে ‘লজ্জিত’ বৃদ্ধা সুফিয়া বলেন, “আমি আর বাড়ির বাইরে বের হতে পারছি না। সবাই আমার ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করছে।
“জানিনা তার ভাগ্যে কী আছে, তবে আমার ছেলের মতো আর কোনো ছেলে যেন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে।”
‘মেয়ের জামাই’ হিসেবে মুসার পরিচয় দিতে নারাজ তৃষার বাবা আব্দুস সামাদ বলেন, “মাইনুল বলেন আর মুসাই বলেন সে এখন দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। আমি তাকে আর জামাই হিসেবে পরিচয় দিতে চাই না। তবে আমার মেয়ে যদি অপরাধী হয় তবে প্রচলিত আইনে যে শাস্তি হবে আমি মেনে নেব।”
বিয়ের আগে মুসা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতেন না বলেও দাবি করেন বাসুপাড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামাদ।
“ওই সময় আমি বুঝিনি। তার আচরণেও কখনো এমন প্রকাশ পায়নি। যদি জানতাম, তাহলে আমি কি আর মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিতাম?”
শুক্রবার রাতে রাজধানীর আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তৃষা তাকে ফোন দিয়েছিল বলে জানান সামাদ।
“রাত সাড়ে ৩টার দিকে অপরিচিত এক নম্বর থেকে আমার মোবাইলে ফোন আসে। বাসার বাইরে ছিলাম, পরে বাসায় গিয়ে ওই নম্বরে ফোন করলে তৃষা বলে, ‘আমার বিপদ, পুলিশ আমাদের বাসা ঘিরে ফেলেছে’। তখন আমি তাকে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলি।”
শুক্রবারের অভিযানে তৃষা ও জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা আত্মসমর্পণ করেছিল। তাদেরকে গোয়েন্দা হেফাজতে রাখা হয়েছে।
আট মাস আগে মুসার সঙ্গে বিয়ের পর থেকে তার মেয়ে ফোনও করত না দাবি করে সামাদ বলেন, “আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতি করি। আমার মেয়েও আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। কিন্তু কী করে তাকে এমন অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল আমরা কল্পনা করতে পারিনি।”
বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে আসা তথ্য অনুযায়ী, গত শতকের শেষভাগে জেএমবি নামের সংগঠনটি জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করে শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে। তিনি ও তার কয়েকজন সহযোগী আফগানিস্তানে যুদ্ধেও অংশ নেন।
তিনি আফগানিস্তান থেকে ফিরলে জেএমবির কর্মকাণ্ড বিস্তৃতি পেতে থাকে। তবে তাদের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ২০০৩ সালের শুরুর দিকে। ওই বছর দিনাজপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রেপ্তার কয়েকজন জঙ্গির কাছে এ সংগঠন সম্পর্কে তথ্য পায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে শায়খ আবদুর রহমানের পরামর্শে জেএমবির শুরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি গঠিত হয়। ২০০৪ সালে সংগঠনটি বেপরোয়া হয়ে উঠে। রাজশাহীর বাগমারা ও নওগাঁর আত্রাই-রানীনগর ছিল তাদের বিচরণক্ষেত্র।
২০০৪ সালের ২০ মে নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলায় ইদ্রিস আলী ওরফে খেঁজুর আলী ও আব্দুল কাইয়ুম বাদশাকে হত্যা করে বাংলা ভাই ও তার সহযোগীরা। এরপর বাদশার মরদেহ উল্টো করে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং খেজুর আলীকে টুকরো টুকরো করে লাশ পুঁতে ফেলা হয় মাটিতে।
গাছে লাশ ঝুলিয়ে রাখার সেই ছবি সংবাদমাধ্যমে এলে দেশজুড়ে রাতারাতি পরিচিত হয়ে ওঠে ‘বাংলা ভাই’ নামটি। ২০০৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার জেএমবি ও জেএমজেবির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে ওই বছর ১৭ অগাস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা ফাটিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয় সংগঠনটি।
২০০৬ সালের ৬ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে বাংলা ভাইকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা গ্রেপ্তার করে। এর চারদিন আগে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খ রহমানকে।
ঝালকাঠি জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যার দায়ে ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।