রামুর সহিংসতার ৪ বছর: বিচার নিয়ে হতাশ ক্ষতিগ্রস্তরা

কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

কক্সবাজার প্রতিনিধিশংকর বড়ুয়া রুমি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2016, 11:09 AM
Updated : 29 Sept 2016, 11:10 AM

বৃহস্পতিবার ঘটনার চার বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের হাতাশার কথা জানান।

রামু উপজেলার হাইটুপি গ্রামের বাসিন্দা উত্তম বড়ুয়ার ফেইসবুক পেইজে কোরআন অবমাননা করে ছবি পোস্ট করেছেন এ অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ওই গ্রামে সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক।

এ ঘটনায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ, জেলা জামায়াতের বর্তমান সেক্রেটারি জিএম রহিমুল্লা, সদর উপজেলার বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান শহিদুল আলম বাহাদুরসহ দেড় হাজারের বেশি লোককে আসামি করে মামলা হয়।

মামলার পিপি মমতাজ আহমদ বলেন, বৌদ্ধ মন্দির ও পল্লীতে হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ১৮টি এবং ক্ষতিগ্রস্ত একজন আরও একটি মামলা করে।

“সব মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু দুটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলেও সাক্ষীদের আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান এবং প্রত্যক্ষদর্শী কোনো সাক্ষী না পাওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষীদের বৈরী ঘোষণা করা হয়েছে।”

হামলায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর সরকারি সহায়তায় নবনির্মিত মন্দির

ওই দুই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ রেখে আদালত সব মামলা অধিকতর তদন্ত করার জন্য পিআইবিকে নির্দেশ দিয়েছে বলে তিনি জানান।

ইতোমধ্যেই পাঁচ মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পিআইবির কাছে পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি জানান।

ঘটনার দিন রাতে উসাইচেন বৌদ্ধবিহার (বড় ক্যাং) এলাকায় হামলায় আহত হন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ ভুলু। তিনি হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একজন সাক্ষী।

আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য না দিতে নানাভাবে চাপ সৃষ্টিসহ হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

“হামলার ঘটনার আগে যারা মিছিল-মিটিং করেছে, লোকজন জড়ো করে উসকানি দিয়েছে, মিছিল সহকারে হামলা সংঘটিত করেছে, তারা এখন প্রকাশ্যে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের অনেকের নাম আসামি হিসেবে মামলার এজাহারে উল্লেখ থাকলেও পরে প্রভাব খাটিয়ে অভিযোগ থেকে বাদ পড়েছে।”

হামলার সময় আগুন

তিনি বলেন, মামলায় নিরপরাধ অনেককে আসামি করা হলেও জড়িত অনেকে বাদ পড়েছে। আসামিরা মামলার গতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সাক্ষীদের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি ও হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে।

তবে প্রভাব সৃষ্টিকারীদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি তিনি।

তিনি বলেন, ঘটনার দিন যা হয়েছে তার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। ঘটনায় জড়িতরা চিহ্নিত।

“আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর আমি দুটি মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছি। ঘটনার দিন যা দেখেছি আদালতকে তা অবহিত করেছি। কিন্তু মামলার অন্য সাক্ষীরা আদালতে প্রকৃত ঘটনার সাক্ষ্য দেননি।”

রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার সংলগ্ন মেরংলোয়া এলাকার বাসিন্দা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল কক্সবাজারের পিপি মো. নুরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “ঘটনার দিন রাতে আমি রামুতে ছিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা করেও হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে পারিনি। অথচ মামলায় আমাকে সাক্ষী করা হয়নি। যাদের সাক্ষী করা হয়েছে তাদের অনেকে ঘটনার দিন রামুতে ছিলেন না এবং অনেকেরই ঘটনার ব্যাপারেও পুরোপুরি ধারণা নেই।”

মামলার আরেক সাক্ষী রামুর চেরাংঘাটা এলাকার ব্যবসায়ী শংকর বড়ুয়া বলেন, “ঘটনার দিন রাতে বৌদ্ধ মন্দিরে অগ্নিসংযোগের খবর শুনে পরিবারের অন্যদের নিয়ে পাশের ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকি। এ সময় রাতের অন্ধকার ও আতংকগ্রস্ত থাকায় হামলার অংশ নেওয়া লোকজনকে চেনা সম্ভব হয়নি। আদালতে আমি এমনই সাক্ষ্য দিয়েছি।”

হামলার আগের একটি মিছিল

রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুবপরিষদের সভাপতি রজত বড়ুয়া রিকু বলেন, “ঘটনার দিন রাতে আমি চট্টগ্রামে ছিলাম। আমি প্রত্যক্ষদর্শী না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানানোর পরও আমাকে সাক্ষী করা হয়েছে। অথচ প্রত্যক্ষদর্শী অনেককে সাক্ষী করা হয়নি।”

রামু উপজেলার হাইটুপি গ্রামের বাসিন্দা ডিটু বড়ুয়া হামলার ঘটনায় আহত হন বলে জানান।

“পোড়া ক্ষতের দাগ ও তাণ্ডবের বীভৎসতা এখনও অজানা আতংকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ঘটনার রাতে যারা মিছিল-মিটিং করেছে, উসকানি দিয়ে লোকজন জড়ো করেছে, মিছিল সহকারে হামলা চালিয়েছে, তাদের ওই দিনের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখলে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য নয়।”

হাইটুপি গ্রামের বাসিন্দা কেতন বড়ুয়া বলেন, “হামলার ঘটনায় যারা জড়িত ছিলেন, তারা এখনও প্রকাশ্যে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের কেউ কেউ আদালতে সাক্ষ্য না দিতে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। এ কারণে ন্যায় বিচার নিয়ে শংকায় ভুগছি।”

হামলার সময় রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রজ্ঞানন্দ বিহারেই ছিলেন বলে জানান।

“হামলার ঘটনা এতই পরিকল্পিত ছিল যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটপাট চালিয়ে অল্প সময়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। এতে তিন শতাধিক ছোট-বড় বুদ্ধমূর্তি, কয়েকটি ভাষায় রচিত প্রাচীন বৌদ্ধ ত্রিপিটকের পাণ্ডুলিপি ও বুদ্ধের দেহাবশেষ লুটপাট ও ধ্বংস হয়ে যায়।”

প্রজ্ঞানন্দ বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রামুর শত শত বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য।

হামলায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর সরকারি সহায়তায় নবনির্মিত বৌদ্ধমূর্তি

“এই ক্ষত আমাদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, যদি আমরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে আবারও মৈত্রী না আনতে পারি। তা পুনরুদ্ধারই আজ সবার সম্মিলিত প্রয়াস হওয়া উচিত।”

রামুর বৌদ্ধ বিহারগুলোতে সরকারি উদ্যোগে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ও সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ সত্যপ্রিয় মহাথের বলেন, পুলিশসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত টহল দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।

“তার পরও হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উর্বর ভূমি রামুতে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের পোড়া ক্ষত বৌদ্ধদের অজানা আতংকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। অবিশ্বাস আর সন্দেহের কারণে এখনও নিজেদের পুরোপুরি নিরাপদ মনে করা সম্ভব হচ্ছে না।”

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ বলেন, রামুর সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনার মামলাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। পুলিশ বরাবরই মামলাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। সাক্ষীরা কেউ আদালতে যেতে ভয় পেলে পুলিশ পাহারায় বাড়ি থেকে আদালতে আনা-নেওয়া করা হবে।

এদিকে ঘটনার চার বছর পূর্তিতে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুবপরিষদ বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে শ্রীকূল লাল চিং চত্বরে।

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের পরপরই জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় অষ্ট উপকরণসহ মহাসংঘদান, দুপুর সাড়ে ১২টায় জ্ঞাতিভোজন, দুপুর ২টায় মৈত্রী র‌্যালি, বিকাল ৩টায় সদ্ধর্ম সভা এবং সন্ধ্যায় সমবেত শান্তি প্রার্থনা ও প্রদীপ প্রজ্বলন।