ছেলেকে জঙ্গি বানানোর জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান যশোর উপশহর ডিগ্রি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাবিবুল্লাহ।
শনিবার রাতে নারায়ণগঞ্জে নিহত একজনের ছবি দেখে হাবিবুল্লাহ তাকে তার ছেলে রাব্বি বলে শনাক্ত করেন। ছবিটি দেখে তিনি শোকে ভেঙে পড়েন।
ওইদিন সকালে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া কবরস্থানের কাছে তিন তলা একটি ভবন ঘিরে পুলিশের অভিযান চলে। এক ঘণ্টার মধ্যে ‘অপারেশন হিট স্ট্রং টোয়েন্টি সেভেন’ শেষ হয়।
পরে সেখান থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়, যাদের মধ্যে ‘নব্য জেএমবি’র নেতা তামিম চৌধুরী ও যশোর এমএম কলেজের ছাত্র ফজলে রাব্বি রয়েছেন।
নিহত অন্যজন ঢাকার ধানমণ্ডির তাওসীফ হোসেন বলে তথ্য পাওয়ার কথা জানালেও পুলিশ তার পরিচয় এখনও নিশ্চিত করতে পারেনি।
যশোরে থাকতেই কাজী ফজলে রাব্বি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বাড়ি থেকে চলে জঙ্গিদের সঙ্গে চলে যাওয়ার বিষয়টি তার পরিবারের সদস্যরা জানত বলে পুলিশের দাবি।
এ পরিবারের প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠজন আফজাল হোসেন দোদুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে বাড়িতে ল্যাপটপ ব্যবহার করত, কিন্তু ঘরে তার বাবা-মা ঢুকলেই তা বন্ধ করে দিত। তার বাসায় জিহাদি নানা বই পাওয়া যায়, যেগুলো তার বাবা নষ্ট করে ফেলেছেন।”
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যশোর সদর উপজেলা কমিটির ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল আরও জানান, রাব্বি এপ্রিলের প্রথম দিকে বাড়ি থেকে চলে যায়। যাওয়ার সময় সে তার বোনকে বলে যায়, 'জিহাদে যাচ্ছি। হাশরের ময়দানে দেখা হবে।'
“তার চলে যাওয়ার পর কাজী হাবিবুল্লাহকে থানায় সাধারণ ডায়রি করতে আমি সহায়তা করেছিলাম,” বলেন তিনি।
আফজাল জানান, “গত শনিবার রাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জে নিহত একজনের (রাব্বি) ছবি দেওয়া হয় আমার কাছে। আমি ছবিটি তার বাবাকে দেখাই। উনি ছবিটি তার ছেলে রাব্বির বলে শনাক্ত করেন। তিনি ছবিটি দেখে মর্মাহত হয়েছেন এবং ভেঙে পড়েছেন।
“ওই সময় তিনি বলে ওঠেন- যারা তার ছেলেকে জঙ্গি বানিয়েছে, সরকার যেন তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়।”
যশোর উপশহর এলাকার কিসমত নওয়াপাড়ায় ‘মদীনা মনজিল’ রাব্বিদের বাড়ি। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে রাব্বি সবার ছোট। তার বাবা কাজী হাবিবুল্লাহ প্রথমে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি।
কিছু সময় পর নিজেই বলেন, “ছেলে মারা গেছে, শনিবার বিকালে জানতে পেরেছি। তার বিষয়ে রিপোর্ট করেন, আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে, আমার ছেলেকে যারা জঙ্গি বানিয়েছে, বিষ খাইয়েছে, সরকার তাদের কেন ধরছে না?”
কারা তার ছেলেকে জঙ্গি বানিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “জামায়াত-শিবির।”
লাশ নিয়ে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, “অবশ্যই আমার ছেলের মরদেহ আনব।”
এলাকায় মাথা নিচু করে চলা এই ছেলেটি যে নারায়ণগঞ্জে নিহত তামিমের সহযোগী, তা অনেকেই ভাবতে পারছেন না। শনিবার রাতেই বিষয়টি প্রতিবেশীরা জানতে পারেন।
রোববার ফজলে রাব্বির বাড়ি গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়।
প্রতিবেশী নাসরিন আক্তার বলেন, “রাব্বিরা কেউই এলাকার লোকজনের সঙ্গে মিশতেন না। তবে তারা ধার্মিক। রাব্বি নিয়মিত বাড়ির পাশে মসজিদে নামাজ পড়তেন।”
বাড়ির পাশের মসজিদে নামাজ পড়েন মো. রবিকুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “ছেলেটি নামাজ-কালাম করত; চিল্লার দাওয়াত দিত। কিন্তু সে যে জঙ্গি সদস্য বা এমন খারাপ কাজ করতে পারে, তা জানতাম না।”
গত মাসে যশোর পুলিশ যে পাঁচজনকে জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করে পোস্টার ছাপে, ফজলে রাব্বির নাম ও ছবি সেই তালিকায় দ্বিতীয় নম্বরে ছিল। তিনি যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
গত ৫ এপ্রিল বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কাজী হাবিবুল্লাহ ছেলে নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে গত ৭ এপ্রিল যশোর কোতয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ৩৬০/০৭.০৪.২০১৬) করেন। ছেলেকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছিলেন।
যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, “এই ছেলেটা যাওয়ার পরে তার বাবা জিডি করেন। প্রথমদিকে তিনি বলেছিলেন, বাড়ি থেকে না বলে চলে যায়। কিন্তু ডিএসবি থেকে আমরা রিপোর্ট পেয়েছি, সে জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে চলে যাওয়ার বিষয়ে বাড়িতে বলে যায়। তার বাবা-মা পরে তাকে ফিরিয়ে আনার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।”
যশোর এমএম কলেজের অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, রাব্বি খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। এসএসসিতে জিপিএ ৫ এবং এইচএসসিতে ৪ দশমিক ৬ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করে। সে এমএম কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। প্রথমবর্ষের রেজাল্টও ভালো ছিল।