শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম উপকূল দিয়ে স্থলভাগে উঠে আসা ঘূর্ণিঝড়টি বৃষ্টি ঝরিয়ে ধীরে ধীরে দুর্বল হলেও গাছ ও বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকজন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের চট্টগ্রাম অফিস ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
চট্টগ্রাম
রোয়ানুর আঘাতে নগরীর বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। ঝড়ো বাতাসে চট্টগ্রাম, আনোয়ারা ও পটিয়া উপজেলায় বহুতল ভবনের কাঁচ ভেঙে ও গাছচাপায় কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।
পিডিবি চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মো. মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, ঝড়ো হাওয়ায় সরবরাহ লাইনে গাছ ও গাছের ডাল ভেঙে পড়ায় বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। পরে অধিকাংশ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
জলোচ্ছ্বাসে নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমি সড়কের একাংশ এবং পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বেড়িবাঁধের পাশে থাকা প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাতাসে উড়ে গেছে পতেঙ্গা থানার কয়লার ডিপো পুলিশ ফাঁড়ি ও সংলগ্ন মসজিদের টিনের চাল। এছাড়া লালদিয়ার চর এলাকা প্রায় চার ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে সকালে নগরীর পাহাড়তলি রেলওয়ে পুলিশ লাইন সংলগ্ন মূল সড়কের ওপর একটি কালভার্ট ভেঙ্গে পড়ায় স্থানীয়রা চলাচল করতে পারছেন না।
এছাড়া সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, আনোয়ারা ও সীতাকুণ্ডের কয়েকটি ইউনিয়ন জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে।
সন্দ্বীপের ব্যবসায়ী সজল সাহা ঝড়ে কিছু কাঁচা ঘর-বাড়িও ভেঙে পড়ার কথা জানিয়েছেন।
আনোয়ারার রায়পুর ও জুঁইদণ্ডী ইউনিয়নের সিংহভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর জানিয়েছেন ইউএনও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
বাঁশখালীর বাসিন্দারাও উপজেলার খানখানাবাদ এলাকায় জোয়ারের পানি ঢোকার কথা জানিয়েছেন।
সীতাকুণ্ডের ইউএনও নাজমুল ইসলাম ভুঁইয়া জানিয়েছেন, উপজেলার কয়েকটি স্থানে বেড়ি বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করেছে।
কক্সবাজার
ঘূর্ণিঝড়ে পর্যটন জেলা কক্সবাজারে দুইজনের মৃত্যু এবং ১০ জন আহত হলেও সার্বিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি কম বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন।
বিকাল ৩টার দিকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, হতাহতরা সবাই কুতুবদিয়ার।
তিনি বলেন, ঝড়ের কারণে কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার সাড়ে ২৮ কিলোমিটার বেড়ি বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। শতাধিক বসত ঘর নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“যা ক্ষতি হয়েছে তা অনেক কম,” বলেন জেলা প্রশাসক।
বরিশাল
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা দুইদিনের বৃষ্টিতে স্থবির হয়ে পড়েছে বরিশালের জনজীবন। পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
শুক্রবার বিকাল ৫টা থেকে বরিশাল থেকে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বাতিল করা হয় ঢাকা-বরিশাল ফ্লাইট। দুর্ঘটনা এড়াতে বন্ধ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহও।
পটুয়াখালী
ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার মধ্যেই পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
রাঙ্গাবালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তপন কুমার ঘোষ জানান, সকালে বেড়ি বাঁধ ভেঙে উপজেলার চরমনতাজ ইউনিয়নের বউবাজার গ্রাম, লঞ্চঘাট ও চরআন্ডা এলাকা প্লাবিত হয়।
রাঙ্গাবালী ছাড়াও দশমিনা ও গলাচিপা উপজেলার বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বেড়িবাঁধ বিহীন চরে বেশকিছু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া ঝড়ের প্রভাবে জেলায় কয়েকশ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। লক্ষ্মীপুর গ্রামে অন্তত ১৫টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
জেলা প্রশাসক এ কে এম শামিমুল হক ছিদ্দিকী জানিয়েছেন, প্লাবিত হয়ে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা খোঁজ নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে।
ঝালকাঠি
রোয়ানুর প্রভাবে ভোর থেকে ভারি বৃষ্টিপাতে জেলার নিম্নাঞ্চলের ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
দুপুর পর্যন্ত ঝড়ো বাতাসে চার উপজেলায় বেশ কিছু ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত ও অর্ধশতাধিক গাছ উপড়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো. মিজানুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসন উপ-বরাদ্দ দিয়ে আশ্রয়ণে ঠাঁই নেওয়া মানুষকে খাবার, পানি সরবরাহসহ সব ধরনের সহযোগিতার ব্যবস্থা করেছে।
ঘূর্ণিঝড়ে জেলার বিষখালী, পায়রা ও বলেশ্বর নদীতীরের সোনাতলা, কাটাখালী, গাবতলী, নলটোনা, পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া, তালতলীর তেতুলবাড়িয়ায় বেড়ি বাঁধ ভেঙ্গে ৪৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
এসব এলাকার বাড়ি-ঘরে জোয়ারের পানি ঢুকেছে। তলিয়ে গেছে কৃষি জমি ও মাছের ঘের। ঝড়ো বাতাসে অসংখ্য গাছপালা ভেঙে পড়েছে। অনেক সড়কের ওপর গাছ উপড়ে পড়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে যান চলাচল। বিদ্যুৎ নেই জেলার অধিকাংশ এলাকায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাইনুর আযম খান জানিয়েছেন, জোয়ারের পানিতে আড়াই হাজার হেক্টর জমির বীজতলা নষ্ট হয়েছে।
ভোলা
ঝড়ে জেলায় অন্তত তিন হাজার ঘরবাড়ি ও দোকানপাট বিধ্বস্ত হয়েছে। জোয়ারে লালমোহন ও মনপুরায় উপজেলার ২০টি গ্রাম ২/৩ ফুট পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
লালমোহন লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কাসেম এবং মনপুরা ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
প্রবল বাতাসের তোড়ে ভোলা সদরের ইলিশা এলাকায় মেঘনা নদীতে বালুভর্তি দুইটি কার্গো ডুবে গেছে।
তজুমদ্দিন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অহিদ উদ্দিন জসিম জানিয়েছেন, ঝড়ে উপজেলায় প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মনপুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার জানান, ঝড়ে তার ইউনিয়নের অন্তত ২০০ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। উপজেলার কলাতলীর চরের অন্তত ৫০টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে।
বাগেরহাট
দুইদিনের টানা বর্ষনে জেলার কিছু নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি থাকায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ায় বন্দরে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বন্দর স্বাভাবিক রয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে জেলার কিছু নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলেও এতে ফসলের ক্ষতি হবে না বলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক আফতাব উদ্দিন জানিয়েছেন।
চাঁদপুর
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানিতে জেলার হাইমচর ও মতলব উত্তর উপজেলার ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব এলাকার লক্ষাধিক মানুষ ।
নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ঝড়ে চর ঈশানবালা এলাকায় ১৫/২০টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ চর এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
হাইমচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নূর হোসেন পাটওয়ারী মেঘনার পানি বেড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ চর ডুবে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
মতলব উত্তর উপজেলায়ও কয়েকটি চল প্লাবিত হলেও বড় কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর জানাতে পারেননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মফিজুল ইসলাম।
রোয়ানুর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাওয়ায় লক্ষ্মীপুরের মেঘনার তীরবর্তি তিন উপজেলার অন্তত ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
রামগতির চর আব্দুল্লাহ, চর গজারিয়া ও মৌলভীর চর, কমলনগরের চর কালকিনি, চর ফলকন ও সদরের চর রমনী মোহন ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এসব এলাকা এখন ২/৩ ফুট পানির নিচে। ভেসে গেছে কয়েকটি কাঁচা ঘর ও মাছের ঘের। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে জেলার অধিকাংশ স্থানে।
ফেনী
ঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে জেলার তিন ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
চরচান্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন খোকন জানান, চরচান্দিয়া, চর দরবেশ ও সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের ঘরবাড়ি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। জোয়ারের পানিতে এসব এলাকার পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে গেছে। ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিপুল সংখ্যক গাছ উপড়ে পড়েছে। শুক্রবার থেকে উপজেলার নয়টি ইউনিয়ন বিদ্যুৎহীন রয়েছে।