পঞ্চগড়ে হিন্দু ধর্মগুরুকে ‘কতল’

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে এক হিন্দু ধর্মগুরুকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তাদের গুলিতে আহত হয়েছেন আরও একজন।

রংপুর প্রতিনিধিপঞ্চগড় ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2016, 05:03 AM
Updated : 22 Feb 2016, 10:25 AM

এই হামলার ধরন অনেকটাই গত বছরের বিদেশি এবং যাজকদের উপর আক্রমণের মতো বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উঠে এসেছে।

নিহত যজ্ঞেশ্বর রায় (৫০) সোনাপোতা গ্রামের সন্তগৌরীয় মঠের অধ্যক্ষ ছিলেন। গৃহত্যাগী এই ধর্মগুরুকে ভক্তরা মহারাজ/প্রভু বলে সম্বোধন করতেন।  

আহত গোপাল চন্দ্র রায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘তোর গুরুজীকে কতল করা হয়েছে’ বলেই তার উপর গুলি চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা।

হামলাকারী তিনজন ছিল এবং তারা এসেছিল মোটর সাইকেলে, জানিয়েছেন আরেক প্রত্যক্ষদর্শী।

রংপুরে গত বছর জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে হামলা এবং ঢাকার আশুলিয়ায় তল্লাশি চৌকিতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডে মোটর সাইকেলে তিনজন ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিল। ওই হামলাকারীদের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে ধারাল অস্ত্রও ছিল।

এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটিতে আইএস, কোনোটিতে আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার দায় স্বীকারের খবর এলেও সেগুলো ভুয়া বলে পুলিশের দাবি। তবে কোনো খুনের কিনারা এখনও করতে পারেনি পুলিশ।

পঞ্চগড়ে যজ্ঞেশ্বর হত্যাকাণ্ডের ১২ ঘণ্টা পর দায় স্বীকার করেও আইএসের বার্তার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যজ্ঞেশ্বর রায়

দেবীগঞ্জ উপজেলা সদরের পাশের সোনাপোতা গ্রামে করতোয়া নদীর পাড়ে মঠে রোববার সকালে দুর্বৃত্তদের হামলা হয় বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।

দেবীগঞ্জ থানার ওসি বাবুল আকতার সাংবাদিকদের বলেন, সকালে যজ্ঞেশ্বর রায় মঠ লাগোয়া বাড়িতে পূজোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় হামলার শিকার হন। একটি মোটর সাইকেলে তিন দুষ্কৃতকারী এসেছিল। মঠের সামনের সড়কে মোটর সাইকেল রেখে দুজন ভেতরে ঢুকে, যাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র ছিল।

ওসি জানান, দুই দুষ্কৃতকারী চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে যজ্ঞেশ্বর রায়কে। এসময় মন্দিরে মঙ্গল আরতিতে যোগ দিতে আসা গোপাল রায় তা দেখে চিৎকার করলে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়।

বাম হাতে দুটি জখম নিয়ে গোপাল রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার বর্ণনা সাংবাদিকদের দেন। 

“গুরুজীর শরীর ভালো না। সকালে মঠের রান্না ঘরে তার জন্য রুটি বানাচ্ছিলাম। ওই সময় গুরুজীর সুস্থতা কামনায় গুণগুণ করে কীর্তন গাইছিলাম। সকাল ৬টা কি সাড়ে ৬টা হবে। এমন সময় গুরুজীর আর্তচিৎকার শুনতে পাই।”

গোপাল রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পান তার গুরুজীর ঘর থেকে বের হচ্ছেন দুজন লোককে। তাদের পরনে প্যান্ট ও জ্যাকেট। জ্যাকেটের টুপি দিয়ে মাথা ঢাকা।

“আমাকে দেখামাত্র ওই দুজন কোমর থেকে পিস্তল বের করে বলতে থাকে, ‘ওই ঘরে যাবি তো তোকেও কতল করব।  তোর গুরুজীকে কতল করা হয়েছে’। ‘তোরা বড় আনন্দে আছিস, রান্না ঘরে কীর্তন গাইছিলি’-বলেই আমার বুক বরাবর গুলি ছুড়তে থাকে ওরা।” 

গোপাল জানান, হামলাকারীদের পিস্তলে গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিল। গুলি আবার ভরার সময় তিনি মঠের একটা দেয়াল টপকে পার হয়ে চিৎকার করে পালিয়ে যান।

শোরগোল শুনে মঠের পাশের বাড়ি থেকে নির্মল চন্দ্র বর্মন নামে আরেকজন বেরিয়ে আসার সময় হামলাকারী সামনে পড়েন। তবে তিনি হামলাকারীদের এড়াতে পারলেও পালানোর সময় আহত হয়েছেন।

দেবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন নির্মল সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ঘুমে ছিলাম। চিৎকার শুনে ঘুমের ঘোরে দরজা দিয়ে বাইরে আসতেই দেখি একজন গুরুকে ছুরি (চাপাতি) দিয়ে কোপাচ্ছে।

“এসময় মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে পিস্তল হাতে উঠতে থাকা একজন নিচে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমি দৌড়ে ঘরের আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাজারের দিকে পালাই।”

দুর্বৃত্তরা ৫/৭ মিনিটের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে মোটর সাইকেলে পালিয়ে যায় বলে ওসি বাবুল জানান। ঘটনাস্থল থেকে একটি অবিস্ফোরিত বোমা, একটি গুলির খোসা, একটি চাপাতি  ও একটি অব্যবহৃত গুলি (কার্তুজ) জব্দ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

দেওয়াল টপকে যাওয়ার সময় কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন বলে গোপাল জানান।

তিন দুর্বৃত্তকে মোটর সাইকেলে চলে যেতে দেখেছেন বলে জানান সৎ রায়।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “লোকজনের চিৎকার ও বিস্ফোরণের শব্দ শুনে আমি এগিয়ে যাই। দেখি একজন সড়কের ওপর মোটর সাইকেলে বসে আছে। দুজন দ্রুত গাড়িতে বসল। মুহূর্তের মধ্যে তারা পঞ্চগড়-বোদা সড়কের দিকে চলে যায়।”

এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চললেও কাউকে আটক করা যায়নি বলে ওসি জানান। ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে করতোয়া নদীর শ্মশানঘাটে দাহ করা হয় যজ্ঞেশ্বর রায়কে।

গোপালের বাম হাতের কনুইয়ের পাশে দুই জায়গায় জখম রয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমান।

“তবে গুলি পাওয়া যায়নি। আমরা রোগীর ভাষ্যমতে ব্যবস্থাপত্রে ‘গানশট’ ইনজুরি বলেছি। তার হাতকে রক্ষা করতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আমরা এখানে দুই দিন দেখব। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।”

হিন্দু অধ্যুষিত ওই এলাকায় এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে পঞ্চগড়ের সব মন্দির-ধর্মশালায় নিরাপত্তা জোরদার ছিল দাবি করে পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহাম্মেদ সাংবাদিকদের বলেন, “কারা হত্যাকারী এবং কী কারণে এমন হল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

“তদন্তের মাধ্যমে দুষ্কৃতিকারী খুঁজে বের করা হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, “পঞ্চগড়ে এমন ঘটনা এটাই প্রথম। দুষ্কৃতিকারীরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতেই এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”

দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পরিমল দে সরকার সাংবাদিকদের বলেছেন, ধর্মগুরু খুনের প্রতিবাদে সোমবার সকালে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা হবে।