যেভাবে ‘বেড়েছেন’ নূর হোসেন

ট্রাক চালকের সহকারী হিসেবে শুরু; এরপর কৃষক লীগ ও বিএনপি ঘুরে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন, যাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার পর ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।

মুজিবুল হক পলাশ, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2015, 01:35 PM
Updated : 16 Jan 2017, 06:28 PM

কেবল সাত খুন নয়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ-কাঁচপুরজুড়ে চাঁদাবাজি, শীতলক্ষ্যা নদী দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা, উচ্ছেদে বাধা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

এসব অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় নূর হোসেনের ‍বিরুদ্ধে ২২টি মামলা রয়েছে। এছাড়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এক মামলায় গতবছর নূর হোসেনকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ওই রায়ের সময় তিনি ছিলেন ভারতের কারাগারে। 

স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময় সিদ্ধিরগঞ্জে ট্রাক চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন নূর হোসেন। এরশাদ আমলে তিনি জাতীয় পার্টিতে ছিলেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার পর দলটিতে যোগ দেন তিনি। এর ধারাবাহিকতায় সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও হন তিনি।

এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালে শামীম ওসমানের হাত ধরে নূর হোসেন যোগ দেন আওয়ামী লীগে। পরে বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ইউনিয়ন কাঁচপুর শাখার সভাপতি হন।

পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়ায় ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এলাকায় ছিলেন না নূর হোসেন। থানার ‘তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী’ হিসেবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাকে ধরতে ইন্টারপোলেরও সহায়তা চাওয়া হয়েছিল।        

নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলে এলাকায় ফেরেন নূর হোসেন। ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এভাবেই ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন তিনি।

নূর হোসেনের এই ‘উত্থান’ কাছ থেকে দেখেছেন বিলুপ্ত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভার প্রশাসক ও বিএনপি নেতা আবদুল মতিন প্রধান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তার যত অপকর্ম আছে তা বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় এসেছে। এলাকার মানুষ সবই জানে। নূর হোসেন কতটা কুখ্যাত, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই।”  

সাত খুনের ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়ার আগে সাংসদ শামীম ওসমানকে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন নূর হোসেন। ওই কথোপকথন ফাঁস হলে গণমাধ্যমে তা প্রকাশ করা হয়।

সেখানে নূর হোসেনকে বলতে শোনা যায়, “ভাই আপনি আমার বাপ লাগেন ভাই। ভাই জীবনটা আপনেরে আমি দিয়া দিমু ভাই। আপনারে আমি অনেক ভালোবাসি ভাই।”

পরে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম। সেখানে ওই কথোপকথনের সত্যতাও তিনি স্বীকার করেন।

বিভিন্ন থানার নথি থেকে জানা যায়, ২০১০ সালে হাই কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে শীতলক্ষ্যার তীর দখল করে বালু-পাথরের ব্যবসা গড়ে তোলায় নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করে বিআইডব্লিউটিএ। সরকারি কাজে বাধা, সরকারি কর্মকর্তাদের হুমকি দেওয়া এবং নদীতীরের প্রায় ৮০০ শতাংশ জমি দখলেরও অভিযোগ আনা হয় ওই মামলায়।

তারপর কয়েক বছরে ওই জমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে আট-দশ বার অভিযান চালানো হলেও নূর হোসেন ও তার সমর্থকদের বাধার মুখে সেসব অভিযান সফলতার মুখ দেখেনি।

গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে কাঁচপুর সেতুর নিচে বালু-পাথরের অবৈধ ব্যবসা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তা আবার চালু হয়।

নূর হোসেন ও তার লোকজনের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১২ সালের অগাস্ট মাসে পুলিশ ও র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ।

তাদের লিখিত অভিযোগে বলা হয়, নূর হোসেনের লোকজন শিমরাইল-কাঁচপুরে বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করে এবং চাঁদা না দিলে মারধর ও গাড়ি ভাঙচুর করে।

পাশাপাশি সিদ্ধিরগঞ্জ সিটি করপোরেশন ট্রাক টার্মিনালে মেলার নামে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক বিক্রির অভিযোগও ওঠে সাবেক এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে একটি রিট আবেদন হলে ২০১৩ সালের এপ্রিলে হাই কোর্ট সেখানে ‘ইনডোর গেমসের নামে অবৈধ কর্মকাণ্ড’ না চালানোর শর্তে মেলা আয়োজনের অনুমতি দেয়। 

এলাকাবাসী জানায়, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত এ সহ-সভাপতি এক সময় ২০টি গাড়ির বহর নিয়ে চলাফেরা করতেন। লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে এলাকায় প্রভাব খাটানোর অভিযোগও রয়েছে তার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে।

সাত খুনের ঘটনার পর ২০১৪ সালের মে মাসে জেলা প্রশাসন নূর হোসেন এবং তার সহযোগীদের নামে নেয়া ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে।

২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনের 
 অভিযোগের আঙুল ওঠে নূর হোসেনের দিকে।

নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম সে সময় অভিযোগ করেন, র‌্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। পরে র‌্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও তার সত্যতা পাওয়া যায়। 

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও এক পর্যায়ে নিরুদ্দেশ হন সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের এই নেতা। ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন এবং র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।

তার আগে ২০১৪ সালের ১৪ জুন দুই সহযোগীসহ কলকাতায় গ্রেপ্তার হন নূর হোসেন। শেষ পর্যন্ত সরকারি পর্যায়ে যোগাযোগের মাধ্যমে ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরদিন তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠান।

২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ‌্য দিয়ে এ মামলার নূর হোস্সেহ ৩৫ আসামির বিচার শুরু হয়।  এর ১১ মাসের মাথায় রায় দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন, তাতে নূর হোসেনসহ ২৬ আসামির ফাঁসির রায় আসে।