২০২১: কোভিড, লকডাউন, রেকর্ড মৃত্যু আর টিকার বছর

একটি ভাইরাস ঠেকাতে অভাবনীয় লকডাউনে জীবনযাত্রা থমকে যাওয়ার এমন দিন আর দেখেনি বাংলাদেশ; সে কারণে বড় একটা সময় ঘরবন্দি করে রাখার কোভিড মহামারীর দ্বিতীয় বছরে স্বাস্থ্য খাতই ছিল আলোচনায়, যার সর্বাগ্রে ছিল ডেল্টা, রেকর্ড সংক্রমণ, মৃত্যুর ভয়াবহতা আর টিকা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2021, 06:45 PM
Updated : 28 Dec 2021, 04:12 AM

হুটহাট নয়, আগের বছরের ধারাবাহিকতায় মহামারীকালে এমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় বাংলাদেশকে। যদিও করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগের বছরের ধাক্কা কাটিয়ে বছরের শুরুটা ছিল আশা জাগানিয়া; যদিও শেষ পর্যন্ত স্বস্তি মেলেনি।

ভাইরাসের নতুন ধরন ডেল্টার কারণে সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার বদলে উল্টো কোভিড পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকে। দ্রুত পাল্টাতে থাকে সার্বিক চিত্র। এক পর্যায়ে হাসপাতালে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থার মধ্যে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে পুরোচিত্র।  

বছরের মাঝামাঝি সময়ে সংক্রমণের তীব্রতায় শনাক্ত ও মৃত্যুর মিছিলের দিনের পর দিন রেকর্ড ভেঙে দেশজুড়ে ভয়াল পরিস্থিতি তৈরি হয়।

 

শ্বাসকষ্ট নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এই রোগীকে ২১ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছিল ভর্তির জন্য। ফাইল ছবি

কোভিডের লাগামহীন এমন বিস্তার ও গুরুতর অসুস্থতার ভয়াবহতার আগে প্রতিষেধক হিসেবে টিকাদান শুরুর কার্যক্রমে যে আশা জেগেছিল, তা হতাশায় পরিণত হয় ভারত টিকাদান বন্ধ করে দিলে।

তবে মহামারী প্রতিরোধে টিকাদান আবারও গতি পায় সরকারের বিকল্প টিকা সংগ্রহের পদক্ষেপে। দুই মাসের বিরতির রেশ কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত দেশের ১১ কোটি মানুষকে অন্তত এক ডোজ টিকা দেওয়া এবং সবাইকে টিকা দিতে মজুদ বাড়ানোর ব্যবস্থাও হয়েছে এ বছরেই।

কয়েক দফায় নজিরবিহীন কঠোর লকডাউন ও নানা বিধিনিষেধের মধ্যে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করার ইতিবাচক ফলও মিলেছে। হুহু করে বাড়তে থাকা কোভিড সংক্রমণ অবশেষে অগাস্টের শেষ দিক থেকে নিম্নমুখী হতে থাকে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তাকে প্রথম ডোজ দিয়ে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান শুরু হয়েছিল।

সেই রুনু ভেরোনিকা কস্তা প্রায় ১১ মাস পর ১৯ ডিসেম্বর বিসিপিএসএ মিলনায়তনে প্রথম বুস্টার ডোজ পেলেন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

একইসঙ্গে এ সময় থেকে টিকাদানে গতি বাড়লে বছর শেষে সংক্রমণ কমে আসে, হাসপাতালগুলোতেও রোগী যাওয়া কমতে থাকে।

এমন স্বস্তির মধ্যেই কোভিডের নতুন আরেকটি ধরণ চোখ রাঙাচ্ছে বছরের একবারে শেষ ভাগে এসে। দেশে দেশে দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া কোভিডের নতুন ধরণ ওমিক্রন আবার আতঙ্ক জাগাচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে বছর শেষের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, “আমরা ষাটোর্ধসহ একটা টার্গেট পিপলকে যদি বুস্টার ডোজ দিতে পারি। মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারি তাহলে হয়ত আরেকটা বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাব।”

বছরের শেষ ছয় মাসে প্রথমার্ধের বিপর্যস্ত অবস্থা বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে উল্লেখ করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডেল্টার কারণে সংক্রমণ অনেক বাড়লেও, মৃত্যু বেশি হলেও আমি মনে করি পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা অনেক ভালো করেছি।

“গত দুই মাসে যে গতিতে টিকাদান কার্যক্রম এগোচ্ছে, তাতে আগামী তিন মাসে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগের কাছাকাছি চলে যাবে।”

ডা. সহিদুল্লাহ মনে করেন টিকার কারণে মানুষের ‘ইমিউনিটি’ তৈরি হয়েছে বলেই কিছুটা সুরক্ষা দিয়েছে। এ কারণেই এখন সংক্রমণ এতটা কমে এসেছে।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এখনও যারা টিকা নেয়নি, তাদের টিকা নেওয়ার তাগিদ দেন জাতীয় পরামর্শক কমিটির সভাপতি।

ডেল্টায় ওলটপালট হিসাব-নিকাশ

বিশ্বকে বিপর্যয়ে ফেলা করোনাভাইরাস মহামারীতে আগের বছরের ধাক্কা সামলে বাংলাদেশে ২০২১ সালের শুরুটা ছিল আশা জাগানিয়া।

রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ৩১ মার্চ গুরুতর অসুস্থ এক কোভিড রোগীর পাশে স্বাস্থ্যকর্মীরা।

ঢাকার রায়েরবাজার কবরস্থানে করোনাভাইরাসে মৃত একজনকে দাফনের পরে মোনাজাতে স্বজনেরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমে ২৯১ জনে নেমে আসে। মৃত্যুও কমে আসে অনেকটা। মহামারীকালের নতুন ধরনের জীবনযাত্রায় সবাই যখন কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে ধাতস্ত হওয়ার পথে তখনই ভয়ের সংবাদ আসতে থাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে। সীমান্তে সতকর্তামূলক পদক্ষেপে ঠেকানো যায়নি ভারত থেকে ছড়িয়ে পড়া কোভিডের নতুন ধরন ডেল্টাকে।

আবার বাড়তে থাকে সংক্রমণ। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ শনাক্তের রেকর্ড ছাড়িয়ে এ বছর ৯ এপ্রিল দৈনিক শনাক্ত সাত হাজার ছাড়ায়। ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো ডেল্টা ধরন নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে ৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম জানান, ভারতফেরত কয়েকজনের নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন শনাক্ত হয়েছে বাংলাদেশেও।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ড।

ঢাকার বাইরে একটি হাসপাতালের সামনে কোভিড রোগীদের নিয়ে স্বজনরা।

জুনের শুরু থেকে এটি দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনাভাইরাসের ভয়াবহ দাপট দেখে বাংলাদেশ। এ সময় শনাক্ত ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ভেঙে যায়।

২৮ জুলাই সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন আক্রান্ত হয়। ৫ ও ১০ অগাস্ট সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়, যা দেশে এক দিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড।

সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী গতি ঠেকাতে ‌১ জুলাই থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন দেয় সরকার। মহামারীর বিস্তার রোধে এর মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়। ঈদের ছুটির জন্য মাঝখানে লকডাউন শিথিল করা হয় এবং এ সময় পরীক্ষার পরিমাণ কমে যাওয়ায় সংক্রমণের হারও কয়েকদিন কম থাকে।

৩০ সেপ্টেম্বর দৈনিক শনাক্ত হাজারের নিচে এবং ৪ অক্টোবর পাঁচশ এর নিচে নামে। এরপর ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক শনাক্ত আর কখনই পাঁচশ এর ঘর ছাড়ায়নি। ১৯ অক্টোবরের পর থেকে দৈনিক শনাক্ত চারশ এর নিচে রয়েছে।

ঢাকার বাইরে একটি হাসপাতালের সামনে কোভিড রোগীদের নিয়ে স্বজনরা।

এ সময় সংক্রমণের সঙ্গে কোভিডে মৃত্যুও কমেছে। গত ২২ অক্টোবর থেকে দৈনিক মৃত্যু ১০ এর নিচে রয়েছে। এরমধ্যে ২০ নভেম্বর এবং ৯ ডিসেম্বর এ ভাইরাসে কারও মৃত্যু হয়নি।

গত ৫ অক্টোবরের পর থেকে টানা আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ২ শতাংশের নিচে রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বিদায়ী বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৭০ হাজার ১১৬ জন। এসময়ে ২০ হাজার ৫০২ জনের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে।

আর ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা বেড়ে হল ১৫ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৬ জন। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

নতুন আতঙ্ক ওমিক্রন

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এ নতুন ধরন বা ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত করার কথা জানান। আলোচনার সুবিধার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর নাম দিয়েছে ‘ওমিক্রন’।

অতি দ্রুত ছড়ালেও এটি ডেল্টার মতো অতটা ভয়াবহ নয়, ওমিক্রন আক্রান্তদের মৃদু উপসর্গ দেখা যাওয়ার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।

করোনাভাইরাসের এ ধরন এরইমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ প্রায় শতাধিক মতো দেশে ছড়িয়েছে। বাংলাদেশেও জিম্বাবুয়ে ফেরত কোভিড আক্রান্ত দুই ক্রিকেটারের দেহে ওমিক্রন ধরা পড়েছে।

ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে এমন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধের সুপারিশ করেছিল কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটি।

তবে সরকার এটির বিস্তার ঠেকাতে আফ্রিকার সাত দেশের যাত্রীদের নিজ খরচে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দ্য়ে।

যশোরের শার্শায় টিকা নিতে মানুষের সারি।

প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে গণটিকা কর্মসূচিতে রেকর্ড সাড়ে ৬৭ লাখ ডোজ কোভিড টিকা দেওয়া হয়। এ কর্মসূচির সময় ঢাকার রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়ে টিকাপ্রত্যাশীদের দীর্ঘ লাইন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

তবে ডেল্টার মতো ওমিক্রনের বাংলাদেশে আসাও ঠেকানো যায়নি। ১১ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বাংলাদেশে প্রথম ওমিক্রনের রোগী ধরা পড়ার কথা জানান।

আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে ফেরত দুই নারী ক্রিকেটারের শরীরে করোনাভাইরাসের এ ধরন পাওয়া যায়। তারা সুস্থ আছেন বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পরে জানিয়েছেন।

টিকায় আশা

মহামারীকালে সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি দেশের মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকার আওতায় আনতে ২০২০ সাল থেকেই কাজ শুরু করে সরকার। ওই বছর ৫ নভেম্বর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ কোভিশিল্ড টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মার সঙ্গে চুক্তিও হয়।

চুক্তির আওতায় কোভিশিল্ডের টিকা প্রথম আসে এ বছরের ২১ জানুয়ারি; ওইদিন ভারত সরকারের উপহার দেওয়া ২০ লাখ ডোজ টিকা পায় বাংলাদেশ। উপহারের দ্বিতীয় চালানে ১২ লাখ ডোজ টিকা আসে ২৬ মার্চ।

সরকারের কেনা তিন কোটি ডোজ টিকার প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ আসে ২৫ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় চালানে ২৩ ফেব্রুয়ারি আসে আরও ২০ লাখ ডোজ।

এরপরই ঘটে ছন্দপতন। ভারতে ডেল্টার আক্রমণে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করলে দেশটি টিকা রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতে বাংলাদেশ সরকারের কেনা ও উপহার মিলিয়ে এক কোটি দুই লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার পর নতুন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।

এতে ইতিমধ্যে শুরু হওয়া টিকা কর্মসূচি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে দেশে যে গণটিকাদান কর্মসূচী শুরু হয়েছিল তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দেয়।

ঢাকায় বঙ্গবন্ধু বিমান ঘাঁটিতে উড়োজাহাজ থেকে নামানো করোনাভাইরাসের টিকা ফ্রিজিং ভ্যানে তোলার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ঢাকার চারটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের দেহে ২৫ মে সিনোফার্মের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়।

এক পর্যায়ে টিকা সঙ্কট দেখা দিলে গত ২৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া স্থগিত করা হয়। টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া চালু থাকলেও মজুদ ফুরিয়ে গিয়ে পুরো কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রমও হয়। অনেক স্থানে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া অলিখিতভাবে বন্ধ করা হয়।

এ সময়কালে সরকারের বিকল্প উদ্যোগের ফসল হিসেবে ১২ মে সিনোফার্মের টিকার পাঁচ লাখ ডোজ বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। ১ জুন কোভ্যাক্স সহায়তা থেকে ফাইজার-বায়োএনটেকের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা আসে। এসব টিকা হাতে এলে দুই মাস সাত দিন পর ১ জুলাই ফের শুরু হয় টিকাদান কর্মসূচি।

টিকায় গতি আনতে সরকার আবার গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু করে। ৭ অগাস্ট শুরু ছয় দিনের এ কর্মসূচির আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়েও করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়।

কর্মসূচির প্রথম দিনেই ২৭ লাখ ৮৩ হাজারের বেশি মানুষ প্রথম ডোজ টিকা পায়। ২৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনের বিশেষ কর্মসূচির আওতায় ৬৬ লাখ ২৫ হাজার ডোজের বেশি করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়।

রাজধানী ঢাকায় কোভিড মহামারীতে কঠোর লকডাউনের সময় পুলিশের চেকপোস্ট।

লকডাউনের ঘোষণা আসার পর ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। ২৬ জুন শিমুলিয়া ফেরিঘাটে মানুষের ঢল।

কতজন পেলেন টিকা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাবে, সারাদেশে ১২ কোটি ২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন সাত কোটি ১১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮২ জন, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪২ দশমিক ২৯ শতাংশ। পূর্ণ ডোজ পেয়েছেন চার কোটি ৯১ লাখ ৪১ হাজার ৬৯৬ জন। এ সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২৯ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের হাতে করোনাভাইরাসের টিকা এসেছে ১৮ কোটি ৫৫ লাখ ৬২ হাজার ৬৯৭ ডোজ।

এরমধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার চার কোটি ৬২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫০ ডোজ, ফাইজার-বায়োএনটেকের এক কোটি ৩২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪০ ডোজ, মডার্নার ৭৯ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬০ ডোজ, সিনোফার্মের ১০ কোটি ৩৩ লাখ ৮৪ হাজার ৭৪৭ ডোজ এবং সিনোভ্যাকের এক কোটি ৪৬ লাখ ৪ হাজার ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ।

সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। দুই ডোজ টিকা দিতে হলে প্রয়োজন হবে প্রায় ২৮ লাখ ডোজ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সরকারের হাতে এখনও মজুদ আছে ছয় কোটি ৬৩ লাখ ৫২ হাজার ২২৮ ডোজ টিকা।

শুরুটা ভারত দিয়ে হলেও বাংলাদেশ এ পর্যন্ত চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে টিকা এনেছে। জাপানসহ কয়েকটি দেশ উপহার হিসেবেও টিকা দিয়েছে।

রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ফেলে যাওয়া মাস্ক। কোভিড এভাবেই যেন অনেক চিহ্ন রেখে যাচ্ছে অজান্তে।

নিজেদের টিকা

প্রতিষেধক হিসেবে বিদেশি কোম্পানির কোভিড টিকা দিয়ে টিকাদান কর্মসূচি শুরুর মধ্যেই নিজেদের টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টাও চলছে।

বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের করোনাভাইরাসের টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বানরের শরীরে ট্রায়ালের পর তা মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে।

এছাড়া দেশে করোনাভাইরাসের টিকা বোতলজাতকরণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এ বছর। গত ১৬ অগাস্ট চীনা কোম্পানি সিনোফার্মের তৈরি টিকা বাংলাদেশে এনে বোতলজাতকরণ ও সরবরাহের জন্য কোম্পানিটির সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার ও ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেড।

চুক্তির আওতায় চীন থেকে বাল্ক টিকা এনে বাংলাদেশে ভায়ালে ভরা এবং লেবেলিংয়ের কাজটি করবে ইনসেপ্টা। তাদের কাছ থেকে সরকার সেই টিকা কিনে নেবে।

নিজেদের এ উদ্যোগের বাইরে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত সাতটি টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়; যেগুলোর মধ্যে ৮ জানুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড প্রথমে অনুমোদন পায়।

এরপর ২৭ এপ্রিল রাশিয়ার স্পুটনিক, ২৯ এপ্রিল চীনের সিনোফার্ম, ২৭ মে ফাইজার-বায়োএনটেক, ৬ জুন চীনের সিনোভ্যাক, ১৬ জুন জনসন অ্যান্ড জনসন এবং ২৪ জুন চীনের ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজি অব দ্য চাইনিজ একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সের টিকা, আইএমবি ক্যাম্পস অনুমোদন পায়।

ঢাকার উত্তরার বাসিন্দা মোহাম্মদ নবাব সাইকেল নিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে এইডিস মশা ও ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে জনসচেতনতা তৈরি করছেন। প্রতীকী মশা হাতে শাহবাগ এলাকায় দেখা যায় তাকে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

 

আবার ডেঙ্গুর হানা

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এ বছর আরেক ভাইরাসও ছড়িয়েছে আতঙ্ক। এইডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুতে ২০১৯ সালের পর বিদায়ী এ বছরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন; শতাধিক মৃত্যুও ভয় ধরিয়েছে দেশজুড়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২৮ হাজার ৩৪৮ জন এইডিস মশাবাহিত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১০৪ জনের।

২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছিল ১৪৮ জনের।

এ বছর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায়ও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ছিল অন্য বছরের চেয়ে বেশি; হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল চার হাজার ৭৬১ জনকে, যাদের মধ্যে ১০ জন মারা যান।

বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর ম্যাগসাইসাই লাভ

স্বাস্থ্যে কোভিড ও ডেঙ্গুর দুসংবাদের মধ্যে এ বছর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর, বি) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. ফেরদৌসী কাদরীর এশিয়ার নোবেলখ্যাত র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার প্রাপ্তি এসেছে ভালো খবর হিসেবে।

গত ৩১ অগাস্ট ২০২১ সালের পুরস্কারের জন্য ফেরদৌসী কাদরীসহ চারজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ঘোষণা করে।

কলেরা আর টাইফয়েডের টিকা তৈরি করে হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য এ সম্মানজনক পুরস্কার পান ড. ফেরদৌসী।

স্বাস্থ্যের ফাইল ‘চুরি’, ঔপনিবেশিক আইনে মামলা

সরকারি ‘নথি চুরির চেষ্টার’ অভিযোগে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের বিষয়টি বছরের মাঝামাঝি সময়ে আলোচনার জন্ম দেয়।

প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে গত ১৭ মে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক কর্মকর্তার কক্ষে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করে ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডিবিধির কয়েকটি ধারায় মামলা করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

রোজিনা ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। আর তার সহকর্মীরা অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘অনিয়ম-দুর্নীতি’ নিয়ে প্রতিবেদন করায় ব্রিটিশ আমলের আইন ব্যবহার করে ‘হয়রানি’ করা হচ্ছে তাকে। ছয় দিন পর জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পান সাংবাদিক রোজিনা।

স্বাস্থ্যের ফাইল ‘গায়েব’

ফাইল চুরির ঘটনাও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় অক্টোবরে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে ১৭ নথিসহ একটি ফাইল হারিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে গত ২৮ অক্টোবর শাহবাগ থানায় জিডি করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নাদিরা হায়দার।

এ অভিযোগে এক ঠিকাদারসহ ১০ জন কর্মচারীকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। এই ঘটনা তদন্তে পুলিশের তদন্তের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

পরে সিআইডি জানায়, ফাইল চুরির তদন্তে আটকদের জিজ্ঞাসাবাদেও বলার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। পরে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এ ঘটনায় চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করার কথা জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।