২০২১: স্কুলের আঙিনা খুলল, খোলা থাকবে তো?

অভূতপূর্ব মহামারীর কারণে নজিরবিহীন প্রতীক্ষা শেষে যে স্বস্তি ও আনন্দ নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরেছিল শিক্ষার্থীরা, করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন এক ধরনের আবির্ভাবের মধ্যে বছর শেষে তার স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় থাকছেই।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Dec 2021, 07:06 PM
Updated : 28 Dec 2021, 07:06 PM

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাংলাদেশেও শুরুর পর ২০২০ সালের মার্চে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়। দেড় বছর পর পরিস্থিতির উন্নতি হলে গত সেপ্টেম্বরে সেই অপেক্ষার অচলায়তন ভাঙে; শ্রেণিকক্ষে ফেরে শিক্ষার্থীরা।

বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে ২০২১ সালের জন্য এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। কারণ একসঙ্গে এতো দীর্ঘ সময় ক্লাস-পরীক্ষা কখনও বন্ধ ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থায় নজিরবিহীন ক্ষতির কথা বলে আসছেন শিক্ষাবিদরা।

বিদায়ী বছরে সীমিত ক্লাস-পরীক্ষা হলেও আসছে বছরে ক্ষতি কতটা পুষিয়ে নেওয়া যাবে, সেটাকেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছিলেন তারা। এর মধ্যেই শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। অতি সংক্রামক এই ধরনটির কারণে বিশ্বজুড়ে আবার কোভিড বিধিনিষেধে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।

ওমিক্রনের কারণে দেশেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ করা হতে পারে বলে এর মধ্যেই বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

গত পৌনে দুই বছরে শিক্ষাব্যবস্থায় মূল প্রভাবকের ভূমিকা রাখা করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়ে ২০২০ সালের ৮ মার্চ। সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যাপক বিধিনিষেধের এক সপ্তাহ পরই বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা থাকলেও তা ছিল সীমিত।

ক্লাসে ফিরতে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হয় ৫৪৩ দিন। মহামারীর প্রকোপ কমে পরিস্থিতি অনুকূলে এলে ১২ সেপ্টেম্বর আবার ক্লাস শুরু হয়। সরাসরি ক্লাস শুরুর পর পরীক্ষার পথও খুলতে থাকে।

প্রায় নয় মাস অপেক্ষার পর বছরের শেষ দিকে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীরা। ১৪ নভেম্বর এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে মহামারীর দেড় বছর পর প্রথম কোনো পাবলিক পরীক্ষায় বসে শিক্ষার্থীরা।

২ ডিসেম্বর শুরু হয় ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা। আগের বছর এসএসসি ও জেএসসির ফল গড় করে উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেছিল সরকার।

মহামারীর অভিঘাতে অনেক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার শঙ্কার কথা উঠে আসছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা প্রতিবেদনে। তার ইঙ্গিত মিলেছে এ দুই পাবলিক পরীক্ষায়; অনুপস্থিতির হার ছিল অনেক বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীরা পড়ে, এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অনুপস্থিতির হার বেশি।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতে, করোনাভাইরাসের কারণে অনেক পরিবার অস্বচ্ছল হয়ে যাওয়ায় অনেক ছেলে-মেয়ে পড়াশুনা ছেড়ে কাজে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে। আর্থিক অনটনে অনেকে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।

“সরকারকে এ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে ক্লাসে ফিরিয়ে আনতে হবে।”

এ সবকিছুর জন্য শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এই অধ্যাপক।

পড়াশোনায় দীর্ঘ বিরতির কারণে এবার প্রাথমিকে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়নি সরকার; নেওয়া হয়নি পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষাও।

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে নিতে পারলেও ধারাবাহিকতা ভেঙে পড়ার প্রভাব যে নতুন বছরেও থাকবে, তা বলছেন শিক্ষামন্ত্রী। আগামীতেও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা বলে জানিয়েছেন তিনি।

সেশনজট এড়াতে মহামারীর মধ্যেই গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় ও আবাসিক হল খুলে দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। টিকা দেওয়া শুরুর পর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে সরব হতে থাকে ক্যাম্পাসগুলো।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠায় এক বছর আটকে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাও শুরু হয় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। প্রথমবারের মতো ছয়টি বিভাগীয় শহরে ভর্তি পরীক্ষা নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এবার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিয়েছে গুচ্ছ পদ্ধতিতে, যা নিয়ে বেশ কয়েকবছর ধরে উদ্যোগ চলছিল। তবে প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুচ্ছ পদ্ধতিতে সায় না থাকায় মহামারীর মধ্যে শিক্ষার্থীদের নানা প্রান্তে ছুটতে হয়।

এদিকে বছর শেষে ১৩ সেপ্টেম্বর একগুচ্ছ পরিবর্তন এনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য নতুন শিক্ষাক্রমের পরিকল্পনা দিয়েছে সরকার। ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সামনে রেখে জানুয়ারিতে ১০০টি প্রাথমিক ও ১০০টি মাধ্যমিক স্কুলে এ শিক্ষাক্রমের ‘পরীক্ষামূলক’ প্রয়োগ’ শুরু হবে।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এর ফলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা, এসএসসির আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়া, নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের বিভাজন তুলে দেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার চাপ কমাতে বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নের আগে শিক্ষাবর্ষজুড়ে চলবে শিখনফল মূল্যায়নও।

শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক করতে এই পরিবর্তনগুলো প্রত্যাশিত ছিল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বড় এই পরিবর্তনের জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে সংশয় আছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়নকেই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বহির্বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোতে এ ধরণের শিক্ষাক্রম রয়েছে। কিন্তু সেই দেশগুলোর মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, শিক্ষকদের দক্ষতা-প্রশিক্ষণ কী আমাদের দেশে আছে? আমাদের দেশে বেশিরভাগ স্কুলের এক একটা ক্লাসে ৮০-১০০ জন, এর বেশিও শিক্ষার্থী রয়েছে। এতোগুলো শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন কি শিক্ষক সঠিকভাবে করতে পারবেন?

“নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হবে, কিন্তু সেজন্য শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সেই শিক্ষাক্রমে পাঠদানের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। এ পদক্ষেপগুলো আগে থেকেই নিয়েই নতুন শিক্ষাক্রম শুরু করা উচিত ছিল। নইলে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না, আবার আরেকটি শিক্ষাক্রম শুরু করতে হবে।”

সরকার অবশ্য একে পরীক্ষা, বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের চাপ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের মুখস্ত নির্ভরতা থেকে বের করে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখার মাধ্যমে পাঠচক্রকে ‘আনন্দময় করার উদ্যোগ’ বলছে।

সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে তৌফিক ইমরোজ খালিদী লাইভে এসে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভুল-ভ্রান্তি বা সমস্যা হতে পারে। সে কারণেই আগামী বছর ২০০টি স্কুলে নতুন শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

তবে বছর শেষে শিক্ষাব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়ালেও মহামারীর ক্ষতি পোষাতে বিশেষ নজর দিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ফাহিমা খাতুন মনে করেন, নতুন বছরের সিলেবাসের সাথে আগের বছরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হলে ক্ষতি কিছুটা হলেও পোষানো যাবে।  

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, শিক্ষাখাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে বৈষম্য কমানোর যে চেষ্টাটা ছিল, সেই জায়গাটায় করোনাভাইরাসের কারণে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইনে ক্লাস হওয়ায় তাদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা গেলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর‌্যায়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে ওঠানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

“প্রাথমিকে এবছর এক-দুইদিন ক্লাস হয়েছে, যেটার মাধ্যমে ক্ষতি এবারও পোষানো যায়নি। তাই নতুন ক্লাস যখন শুরু করা হবে, তখন আগের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পোষানোর জন্য সিলেবাসে পাঠ্যক্রমের আগের অংশও রাখতে হবে। যেটা প্রাথমিকে এ বছরও ছিল। অষ্টম শ্রেণি পর‌্যন্ত সেটা অব্যাহত রাখতে হবে।

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফেরানোটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আখতার।

তিনি বলেন, “নইলে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ শিক্ষার বাইরে থেকে যাবে।”

আরও পড়ুন: